অনুপম হাজরা। —ফাইল চিত্র।
বার বার দলের রাজ্য নেতৃত্বের সমালোচনা করে আখেরে বিরোধীদের ‘সুবিধা’ করে দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় বিজেপির সম্পাদক অনুপম হাজরা। তাঁর জন্য ক্রমাগত ‘অস্বস্তিতে’ পড়ছে দল। অনুপমের বিরুদ্ধে এমনই সব অভিযোগ নিয়ে এ বার কেন্দ্রীয় বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে নালিশ করতে চলেছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি সূত্রের খবর, অনুপম যে ভাবে রাজ্যের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছেন, তাতে সার্বিক ভাবে দলেরই ক্ষতি হচ্ছে। তাই অবিলম্বে এ নিয়ে দিল্লিতে দরবার করতে চাইছে রাজ্য বিজেপি।
রাজ্য বিজেপির সভাপতি থাকাকালীন দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ করেছিলেন রাজ্য বিজেপির একাংশ। তার পরে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা চিঠি পাঠিয়েছিলেন দিলীপকে। গেরুয়া শিবিরের একটি অংশ জানাচ্ছে, অনুপমের ক্ষেত্রেও তেমন কোনও পদক্ষেপ চাইছেন তাঁরা। যদিও বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে তাঁরা কোনও মন্তব্য করতে চান না কেউ। কারণ, দলের বাইরে কেন্দ্রীয় নেতার সমালোচনা করা সমীচীন নয়। তা দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী বলে জানাচ্ছেন রাজ্য নেতৃত্ব।
বস্তুত, দলের ভিতরে থেকে দলকে নিয়ে বরাবরই ‘ভোকাল’ অনুপম। বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তব্য এবং সমাজমাধ্যমে লেখালেখিতে অস্বস্তিতে পড়েছে দল। নেতৃত্বের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিন্তু অনুপম আছেন অনুপমেই। মঙ্গলবার অনুপমকে দেখা গিয়েছে শান্তিনিকেতনে তৃণমূলের ধর্নামঞ্চে। তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছেন তিনি। তার পর ফলক-বিতর্কে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে বেলাগাম আক্রমণ করেছেন। উপাচার্যকে ‘ভণ্ড’ বলেছেন। বলেছেন, উপাচার্য বিজেপি সেজে কার্যকালের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে চাইছেন বিদ্যুৎ। বিজেপি নেতা অনুপম এমনও দাবি করেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারও বিদ্যুৎকে নিয়ে বিরক্ত। উপাচার্য বার বার ‘রবীন্দ্রবিরোধী’ মন্তব্য করেছেন। তিনি যে ভাবে বিশ্বভারতী তথা বোলপুরবাসীর আবেগে আঘাত করেছেন, তা একেবারে মেনে নেওয়া যায় না। তাই তাঁর কাজের মেয়াদকাল বৃদ্ধি হবে না। কটাক্ষ করে অনুপম বলেছেন, ‘‘বিদ্যুৎ উপাচার্য পদ ছাড়লে শান্তিনিকেতন গোবরজল দিয়ে পরিশুদ্ধ করা হবে।’’
প্রসঙ্গত, তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে এসেছিলেন অনুপম। বিজেপি তাঁকে গত লোকসভা ভোটে টিকিট দিয়েছিল যাদবপুরে। সেখানে তৃণমূলের মিমি চক্রবর্তীর কাছে হারেন তিনি। তবে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তৃতীয় স্থানে ছিলেন সিপিএমের বিকাশ ভট্টাচার্য। অনুপমের সাম্প্রতিক কাণ্ডকারখানায় বিজেপির অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, লোকসভা ভোটের আগে তিনি কি আবার শিবির বদল করতে চাইছেন। বর্তমান দলের প্রকাশ্যে সমালোচনা করে তিনি কি আসলে প্রাক্তন দলকে ‘বার্তা’ দিতে চাইছেন?
তৃণমূলের মঞ্চে উপস্থিতি এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে অনুপমের প্রকাশ্যে এমন মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিজেপির রাজ্য নেতারা। রাজ্য বিজেপির মুখ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য জানান, এটা তাঁদের ‘পার্টি লাইন’ নয়। পাশাপাশি, দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদকের বক্তব্যের ‘গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। শমীকের কথায়, ‘‘অনেকে এখনও দলের সংস্কৃতিটা বুঝে উঠতে পারেননি। কেউ কেউ খিদে পেটে রয়ে গিয়েছেন।’’ নাম না করে অনুপমকে নিশানা করে তিনি বলেন, ‘‘কেউ কেউ নির্বাচনের সময় অনুব্রত মণ্ডলের (বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি। গরু পাচার মামলায় বর্তমানে জেলবন্দি) বাড়িতে মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে হজম হয় কি না, সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন। কিন্তু বিজেপি কোনও অবস্থাতেই কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার এবং স্বশাসনকে ধ্বংস করতে চায় না। কোনও উপাচার্যকে কোনও কদর্য ভাষায় আক্রমণ বিজেপি অনুমোদন করে না। এটা বিজেপির সংস্কৃতির পরিপন্থী।’’
পাল্টা শমীককে ‘এসি ঘরে বসা তোতাপাখি’ বলে কটাক্ষ করেন অনুপম। বিশ্বভারতীতে এক সময় শিক্ষকতা করা অনুপম যুক্তি দেন, শমীক যে হেতু বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করেননি বা বোলপুরের বাসিন্দা নন, তাই উপাচার্যের বিষয়টি তাঁর অজানা। তিনি সেই ‘আবেগ’ও অনুভব করতে পারবেন না। তাঁর মতো নেতারা শুধু ‘কিছু শেখানো বুলি আওড়ান।’ এখানেই শেষ হয়নি। মঙ্গলবার বিকেলে নানুর বিধানসভার কীর্ণাহার-২ অঞ্চলের ফেউগ্রামে একটি দলীয় কার্যালয়ের উদ্বোধনে গিয়েও রাজ্য নেতৃত্বের একাংশকে নিশানা করেন অনুপম। কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘দলের মধ্যে যে সমস্ত ভাইরাস আছে, সেই ভাইরাসকে আগে বার করুন। দরকার পড়লে দু-চারটে থাপ্পড় মারতে হয় মারুন! কোনও অসুবিধা নেই।’’ পাশাপাশি, দলের মধ্যে তাঁকে ‘কোণঠাসা’ করে রাখারও অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় বিজেপির সম্পাদক। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যের কোর কমিটির মধ্যে আমি ঢুকে গেলে ওলটপালট হয়ে যাবে। যে সিন্ডিকেট চলে ওই সিন্ডিকেটগুলো ঘেঁটে যাবে। এই জন্যই আমাকে কোনও রাজ্য অফিসের বৈঠক বা অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না।’’
তাঁর এই সব মন্তব্যে স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে রাজ্য বিজেপির নেতারা। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে তাঁরা প্রকাশ্যে আর মন্তব্য করতে চান না। গেরুয়া শিবিরের এক নেতা বলেন, ‘‘সরাসরি বিষয়টি দিল্লির শীর্ষ নেতৃত্বের কানে তুলতে চাইছি আমরা।’’ ইতিমধ্যে সেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে বলেও খবর। এ নিয়ে অনুপমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।