আলোচনা অনেক বিজেপি নেতার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নিয়েই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
নিজেদের আরএসএসের ‘ঘনিষ্ঠ’ প্রমাণ করতে গিয়ে সঙ্ঘের রীতি ভাঙছেন অনেক বিজেপি নেতা। এমনই অভিযোগ উঠেছে সঙ্ঘ পরিবারের অন্দরে। বিজেপি নেতাদের একাংশও এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। তাঁদের বক্তব্য, সঙ্ঘ ব্যক্তিপূজার বিরোধী হলেও কয়েকজন নবাগত বিজেপি নেতা সেটা করছেন। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের জন্ম বা মৃত্যুদিন আরএসএস পালন করে না। কিন্তু সম্প্রতি সেটাই করেছেন দলের সাংসদ অর্জুন সিংহ, সৌমিত্র খান, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীরা। শুভেন্দু প্রসঙ্গে আরও কট্টরপন্থী সঙ্ঘকর্তারা একটি ঘটনার উল্লেখও করছেন। সম্প্রতি একটি ভাইরাল ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে ভার্চুয়াল বৈঠকের সময় চেয়ারে বসে সঙ্ঘের প্রার্থনা আবৃত্তি করছেন শুভেন্দু। আরএসএস শিবিরের বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, বসে বসে প্রার্থনা আবৃত্তি করা ‘মর্যাদাহানিকর’।
তবে একইসঙ্গে তাঁরা এ-ও জানেন যে, বিজেপি শীর্ষনেতৃত্ব শুভেন্দুকে দলের অন্দরে কতটা স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। ফলে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও উচ্চবাচ্য করতে তাঁরা নারাজ। যা আলোচনা হওয়ার সঙ্ঘের অন্দরেই হচ্ছে। যেমন হচ্ছে রাজ্য বিজেপি-র একটি অংশে।
রাজ্য বিজেপি-তে আড়াআড়ি একটি বিভাজন রয়েছে। একটি শিবিরে রয়েছেন আরএসএস থেকে রাজনীতিতে আগতরা। অন্য শিবিরের সদস্যরা সরাসরি রাজনীতিতে এলেও ধীরে ধীরে সঙ্ঘ পরিবারের আদব কায়দার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। ইদানীং তৃতীয় একটি শিবির তৈরি হয়েছে, যাঁরা সাম্প্রতিক কালে অন্য দল থেকে বিজেপি-তে এসেছেন। তাঁদের একটি অংশের মধ্যে সঙ্ঘের রীতি ভেঙে ব্যক্তিপূজার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সঙ্ঘ শিবিরের এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘সঙ্ঘ কোন কোন দিন পালন করে, সেটা এঁরা জানেন না। ফলে সে সব দিন বাদ দিয়ে ডাক্তারজির মৃত্যুদিনে ছবি-সহ টুইট করেছেন। এটা সঙ্ঘের রীতিবিরুদ্ধ।’’
প্রসঙ্গত, আরএসএস বছরে যে ক’টি দিন উৎসব পালন করে, তার শুরু হয় চৈত্র শুক্ল প্রতিপদ তিথিতে। ওই দিন ‘বর্ষ প্রতিপদ’ অনুষ্ঠান পালন হয়। ওই দিনটিকে ‘হিন্দু নববর্ষ’ হিসেবে পালন করে আরএসএস। এর পর ‘হিন্দু সাম্রাজ্য দিবস’ পালিত হয় জ্যৈষ্ঠ শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে। যা ছিল গত বুধবার, ২৩ জুন। সে দিন আরএসএস-এর টুইটার হ্যান্ডল থেকেও শিবাজির রাজ্যাভিষেক দিবস পালনের বার্তা দেওয়া হয়েছিল। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আরএসএস-এর প্রাক্তন প্রচারক। বুধবার তিনিও ‘হিন্দু সাম্রাজ্য দিবস’ উপলক্ষে টুইট করেছিলেন। কিন্তু তা করতে দেখা যায়নি শুভেন্দু, অর্জুন বা সৌমিত্রকে। কিন্তু গত ২১ জুন হেডগেওয়ারের প্রয়াণদিবসে টুইট করেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, কেউ কেউ সঙ্ঘের প্রাক্তন সরসঙ্ঘ চালকদের জন্মদিন, মৃত্যুদিনেও টুইট করছেন। যে প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপি-র এক নেতার বক্তব্য, ‘‘এঁরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরে আসার জন্য নিজেদের সঙ্ঘ অনুগামী প্রমাণ করতে গিয়ে সঙ্ঘের রীতিই ভাঙছেন।’’
পশ্চিমবঙ্গ আরএসএস-এর প্রবীণ প্রচারক তথা ‘স্বস্তিকা’ পত্রিকার (আরএসএস মুখপত্র) প্রাক্তন সম্পাদক বিজয় আঢ্য বলেন, ‘‘কোনও দিবস পালন করতে হলে আগে সঙ্ঘের আদর্শ বুঝতে হবে। সঙ্ঘ ব্যক্তিপুজোয় বিশ্বাস করে না। তাই প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিনও পালিত হয় না। সঙ্ঘের গুরু গৈরিক পতাকা।’’ সঙ্ঘের উৎসব সম্পর্কে বিজয় আরও বলেন, ‘‘বর্ষ প্রতিপদ, হিন্দু সাম্রাজ্য দিবস, গুরুপূর্ণিমা, রক্ষাবন্ধন (রাখি পূর্ণিমা), বিজয়া দশমী ও মকর সংক্রান্তি— এই ছ’টি উৎসব ছাড়া অন্য কিছু পালন করে না সঙ্ঘ। এর মধ্যে গুরুপূর্ণিমায় গৈরিক ধ্বজ (সঙ্ঘের পতাকা) ও বিজয়া দশমীতে অস্ত্রপূজন ছাড়া আর কোনও রকম পুজো হয় না। মকর সংক্রান্তিতেও পুজো হয় না। সেদিন তিলের নাড়ু খাওয়া হয়। তিল স্নেহ-ভালবাসা এবং গুড় সংগঠনের প্রতীক। হালকা তিল গুড়ের মিশ্রণে সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।’’
বিজয় আরও জানান, সঙ্ঘের প্রতিদিনের শাখা বা অন্য যে কোনও অনুষ্ঠানের শুরুতে বা শেষে প্রার্থনা করা হয়। একমাত্র গৈরিক পতাকার সামনে নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখেই সেই প্রার্থনায় অংশ নেওয়া যায়। শুভেন্দুর চেয়ারে বসে প্রার্থনা করা প্রসঙ্গে বিজয় বলেন, ‘‘স্বয়ংসেবকরা নিয়মিত নির্দিষ্ট কিছু রীতি পালন করেন। সেটাই সঙ্ঘের শৃঙ্খলা। একজন মানুষের আচার- ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায় তিনি সঙ্ঘকে কতটা অনুভব করতে পেরেছেন। রাজনীতিতে এসে অনেকে নিজেদের সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ প্রমাণের চেষ্টা করেন বটে। কিন্তু তাঁদের আচার-আচরণ তেমন বলে না। তবে সে সবের বিরোধিতা করা আমাদের কাজ নয়। কোনটা সত্যি আর কোনটা অসত্য দাবি, তা সঙ্ঘকে যাঁরা জানেন তাঁরা একবার দেখলেই বুঝে যাবেন।’’