R G Kar Protest

১৭ বছরের ব্যবধানে একই দৃশ্য দেখছে বাংলা, নাগরিক আন্দোলনে প্রতিবাদ-প্রতীক হয়ে হাতে-হাতে মোমবাতি

দেশে বহু ঘটনার প্রতিবাদে মোমবাতি নাগরিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। দেশের বাইরেও নজির অনেক। স্লোভাকিয়া থেকে দক্ষিণ কোরিয়া, দিল্লি থেকে অতীতে কলকাতা— বারংবার মোমবাতি হয়েছে প্রতিবাদের অভিজ্ঞান।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:১২
RG Kar Protest: Sales of candles boosted by civil society movement

আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে নাগরিক আন্দোলন। ছবি: এএফপি।

প্রথম দেখেছিল ২০০৭ সালে। দ্বিতীয় এই ২০২৪ সালে। মাঝের ব্যবধান ১৭ বছর। কিন্তু নাগরিক আন্দোলনে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে বাংলায় ফিরে এসেছে মোমবাতির প্রজ্বলিত শিখা।

Advertisement

১৭ বছরের ব্যবধানে সেই নাগরিক আন্দোলনের ফলাফলের মধ্যে মিলও রয়েছে। হতে পারে কাকতালীয়। হতে পারে সমাপতন। কিন্তু মিল আছে। ২০০৭ সালে রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুর পরে কলকাতা শহরে যে নাগরিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, সেখানে প্রথম মোমবাতি হাতে মিছিল দেখেছিল কলকাতা। দেখেছিল বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত। সেই আন্দোলনের চাপে সরে যেতে হয়েছিল কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়কে। ১৭ বছর পরে লালবাজার থেকে সরতে হল পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। যার কারণ, আরজি কর হাসপাতালে ঘটে-যাওয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় বিচার চেয়ে নাগরিক আন্দোলন। যে আন্দোলনে হয়েছিল ‘রাত দখল’। সে রাতে নাগরিকদের হাতে ছিল জ্বলন্ত মোমবাতি।

এটা ঠিক যে, প্রতিবাদের ‘অভিজ্ঞান’ হিসেবে মোমবাতি কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দেখা যায়নি। বিচার চেয়ে মোমবাতি হাতে বিশাল নাগরিক মিছিল দেখা গিয়েছিল দেশের রাজধানী নয়াদিল্লিতে। নব্বইয়ের দশকের শেষে দিল্লির পানশালায় মডেল জেসিকা লালকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ঘটনার বিচার চেয়ে রাজপথে নেমেছিল জনতা। মোমবাতিতে প্রতিবাদ এবং শোকপ্রকাশ দেখেছিল দেশ। কলকাতায় সে দৃশ্য দেখা গিয়েছিল রিজওয়ানুরের মৃত্যুর পরে।

উল্লেখ্য যে, তার অব্যবহিত আগে ঘটে যাওয়া সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে মোমবাতির ব্যবহার দেখা যায়নি। কারণ, সেই আন্দোলন ছিল ‘রাজনৈতিক’। রিজ-কাণ্ডের পরে মূলত নাগরিক ক্ষোভই আছড়ে পড়েছিল শহর কলকাতায়। পরে যা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশেও। ১৭ বছর পরে আরজি কর আন্দোলনে প্রথাসিদ্ধ রাজনীতির ‘অনুপ্রবেশ’ এবং দলীয় ঝান্ডার ‘অনধিকার প্রবেশ’ এখনও পর্যন্ত ঠেকিয়েছে জনতা। বিজেপির সাংসদ-বিধায়কদের যেমন ‘গো ব্যাক’ স্লোগান শুনে ফিরতে হয়েছে, তেমনই ফিরতে হয়েছে প্রদেশ কংগ্রেসের সদ্যনিযুক্ত সভাপতিকেও। নাগরিক আন্দোলনের মোমবাতির আলোয় তাঁদের আলোকিত হতে দেওয়া হয়নি সচেতন ভাবে।

আন্দোলনের ‘প্রতীক’ বা ‘অভিজ্ঞান’ হিসাবে মোমবাতির যে পুনরুত্থান ঘটেছে, তা বাণিজ্যিক ভাবেও বাস্তব। উৎসবের মরসুম শুরুর আগে মিছিলের মরসুমে দেদার বিকিয়েছে মোমবাতি। বড়বাজারের পাইকারি মোমবাতি ব্যবসায়ীরা তেমনই জানিয়েছেন। রাজা কাটরা মার্কেটে মোমবাতির পাইকারি বাজার রয়েছে। সেখানকার ব্যবসায়ী অমিত কুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘এই সময়ে মোমবাতির বিক্রি বেড়েছে। তবে আমরা ৩৬৫ দিন মোমের ব্যবসা করি। আমাদের থেকেও এটা বেশি বুঝতে পারছেন তাঁরা, যাঁরা পুজোর আগে থেকে দীপাবলি— এই সময়টায় মোমবাতির ব্যবসা করেন।’’ রাজা কাটরার আর এক মোমবাতি ব্যবসায়ী মহাদেব সাঁধুখা দু’মাসের জন্য মোমবাতির ব্যবসায় লগ্নি করেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অন্যান্য বার সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে উৎসবের জন্য মোমবাতির ব্যবসা হয়। তবে এ বছর অগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকেই তা বেড়েছে।’’ এখন অবশ্য অনেক ধরনের মোমবাতিই পাওয়া যায়। মহাদেব অবশ্য নির্দিষ্ট ভাবেই বলেছেন, ‘‘যে মোমবাতি হাতে নিয়ে মিছিলে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে জনতাকে, সেই মোমবাতিই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।’’

কলকাতা শহরের একটি নামী অন্দরসজ্জা সংস্থার পদস্থ কর্মচারী হাওড়া সালকিয়ার বাসিন্দা সুতনু ভট্টাচার্যও মনে করেন, আরজি কর আন্দোলনে ভিন্ন প্রেক্ষিতে মোমবাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘এখন প্রায় সব ফ্ল্যাটেই বসার ঘরে একটা ভাল জায়গায় মোমদানি রাখার চাহিদা থাকে। যা মূলত শৌখিনতা। কিন্তু আরজি কর আন্দোলনে তা নয়। আন্দোলনের জন্য জ্বালানো মোমবাতি আলাদা।’’

সমাজকর্মী তথা অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষের অভিমত, মোমবাতি ‘কোমলতার অনুষঙ্গ’ বদলাচ্ছে। আরজি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া নাগরিক আন্দোলনে তেমনই দেখা যাচ্ছে। তবে এখানে একটি সূক্ষ্ম বিতর্কও রয়েছে বলে দাবি শাশ্বতীর। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ কেউ বলছেন, কেন মোমবাতি? কেন দাউ দাউ আগুনের মশাল নয়?’’ তবে এ-ও বাস্তব যে, নাগরিক আন্দোলনে মোমবাতির সঙ্গে এ বার মশালেরও ব্যবহার দেখা গিয়েছে। হাইল্যান্ড পার্ক থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত ‘রিলে’ মশাল মিছিলও দেখেছে মহানগর। যা বিকালে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল মধ্যরাতে। তবে মোমবাতির ব্যবহার বৃদ্ধিকে ‘ইতিবাচক’ বলেই অভিহিত করেছেন শাশ্বতী।

আরজি করের ঘটনার প্রেক্ষিতে যে ‘গণক্ষোভ’ তৈরি হয়েছে, সে কথা মাথায় রেখে অনেক জায়গাতেই পুজোর আয়োজনে এ বার আড়ম্বর থাকছে না। তার বদলে বেছে নেওয়া হচ্ছে ‘অগ্নিশিখা’। যেমন বিজেপি নেতা সজল ঘোষের পুজোর উদ্বোধন হচ্ছে প্রদীপ জ্বালিয়ে। তাঁর পুজোর প্রতিমা যে দিন মণ্ডপে আনা হয়েছিল, সে দিন রাস্তার দু’পাশে মোমবাতি জ্বালিয়েছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। মূলত বিচারের দাবিতেই ওই প্রদীপ প্রজ্বলন হবে বলে দাবি সজলের।

গত দু’দশকে এ দেশে বহু ঘটনায় মোমবাতি প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। দেশের বাইরেও নজির কম নয়। ১৯৮৮ সালে অধুনা স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভায় হাজার হাজার মানুষ মোমবাতি হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন। তখন স্লোভাকিয়া পৃথক রাষ্ট্র হয়নি। চেকোস্লোভাকিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। মূলত কমিউনিস্ট শাসকের বিরুদ্ধে তথা ধর্মীয় স্বাধীনতার দাবিতে মোমবাতি হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন মানুষ। তার ঠিক দু’বছর পর ১৯৯০ সালে টেলিযোগাযোগে অতিরিক্ত কর চাপানোর প্রতিবাদে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন মোমবাতি হাতে। যাকে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে ‘মোমের আলোয় বিপ্লব’ বলে উল্লেখ করা হয়। দিল্লিতে নির্ভয়া-কাণ্ডের পরেও দেখা গিয়েছিল মোমের আলোয় প্রতিবাদ। মুম্বইয়ে ৯/১১ হামলার পরেও প্রতিবাদে এবং শোকের বহিঃপ্রকাশে জ্বালানো হয়েছিল মোমবাতি। কলকাতায় আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে সেই অভিজ্ঞান সংক্রামিত হয়েছে কলকাতা শহর ছাড়িয়ে জেলা এবং মফস্সলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement