শাস্তি ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই হাই কোর্টে মামলা দায়ের রাজ্যের। —ফাইল চিত্র।
আরজি কর মামলায় ধর্ষক-খুনি সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে মঙ্গলবার প্রথমার্ধেই কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করেছে রাজ্য সরকার। সোমবার রাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার উচ্চ আদালতে যাবে। সেই মতোই মঙ্গলবার সাতসকালেই মামলা দায়ের এবং গৃহীত হয়েছে। কিন্তু এত তড়িঘড়ি কেন? কারণ, মমতার এই সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক’। অর্থাৎ, রাজনীতিক মমতা প্রশাসক হিসাবে ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আরজি কর-কাণ্ডের পরে তৈরি হওয়া নজিরবিহীন নাগরিক আন্দোলন প্রশাসক মমতাকে ‘বিড়ম্বিত’ই করেছিল। তৃণমূলের সকলেই মানেন, গত সাড়ে ১৩ বছরের শাসনে মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রশাসক মমতাকে এই ধরনের আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়নি। যে আন্দোলনে জুড়ে ছিলেন বিপুলসংখ্যক মহিলা। যে আন্দোলনে সরকার-বিরোধিতার জোরালো স্বর উঠেছিল। প্রশাসনের একাধিক কর্তা এবং শাসকদলের অনেক নেতারই বক্তব্য, আরজি কর দিয়েই আরজি করের ক্ষতে ‘প্রলেপ’ দেওয়ার পদক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
হাসপাতালের অভ্যন্তরে চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছিল। প্রশ্ন উঠেছিল কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। উল্লেখ্য, আরজি কর নিয়ে আন্দোলন যখন ধূমায়িত হতে শুরু করে, তখন পাল্টা রাস্তায় নেমে তাকে আটকানোর প্রাথমিক কৌশল নিয়েছিল তৃণমূল। মমতা নিজে মৌলালি থেকে ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত মিছিল করেছিলেন। সে দিনই তিনি দাবি তুলেছিলেন, ধর্ষক-খুনির ফাঁসি চান তিনি। তার পরে ওই মামলার তদন্তভার আদালতের নির্দেশে যায় সিবিআইয়ের হাতে। কিন্তু নিম্ন আদালতে সিবিআই যে তথ্যপ্রমাণ পেশ করেছে, তার ভিত্তিতেই মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে দোষী সাব্যস্ত করে সঞ্জয়কে আজীবন কারাবাসের (বা আমৃত্যু কারাবাস বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড) নির্দেশ দিয়েছে আদালত। শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস তাঁর রায়ে ব্যাখ্যা করেছেন, কেন তিনি মনে করছেন না আরজি করের ঘটনা ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’, যা শুনে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি ‘স্তম্ভিত’!
তার পরেই তিনি জানিয়ে দেন, ওই রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন জানাবে রাজ্য সরকার। রাত পোহাতে না পোহাতে ঘটনাপ্রবাহ সেই দিকেই এগিয়েছে। কিন্তু এই ‘দ্রুততা’ কেন?
প্রশাসনের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘আরজি করের ঘটনা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, তাতে যাবজ্জবীন কারাদণ্ডের শাস্তিকে চ্যালেঞ্জ করে দোষীর ফাঁসির দাবিতে হাই কোর্টে আবেদন করে রাজ্য সরকার জনমানসে বার্তা দিতে চেয়েছে যে, তাদের আসল মনোভাব কী?’’ তৃণমূলের এক প্রাক্তন সাংসদের বক্তব্য, ‘‘আরজি কর পর্বে মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে আমাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছিল সিপিএম-বিজেপি। নামে নাগরিক আন্দোলন হলেও সেখানে মিশে ছিল বাম এবং অতিবামেরা। রায় নিয়েও বহু মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। সরকার হাই কোর্টে গিয়ে তাতেই মান্যতা দিয়েছে।’’
আরজি করের ধর্ষণ-খুনের মামলায় শাস্তি ঘোষণার অব্যবহিত পরেই তৃণমূলের তরফে সংগঠিত ভাবে একটি কথা বলা হতে থাকে। তা হল: সম্প্রতি জয়নগর, ফরাক্কা এবং গুড়াপে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় দোষীর ফাঁসির সাজা হয়েছে। সেই মামলাগুলির তদন্তভার ছিল রাজ্য পুলিশের হাতে। অর্থাৎ, রাজ্যপুলিশ ফাঁসির শাস্তি ‘আদায়’ করতে পেরেছে। সিবিআই পারেনি। সোমবার রাতে একই কথা জানান মমতাও।
দ্বিতীয়ত, সঞ্জয়ের ফাঁসি চেয়ে হাই কোর্টে যাওয়া সিবিআইয়ের উপর ‘চাপ’ তৈরিরও কৌশল। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘গুড়াপ, ফরাক্কা বা জয়নগর— সব ক্ষেত্রেই নির্যাতিতা ছিল নাবালিকা। ফলে সেই মামলাগুলি হয়েছিল পকসো আইনে। পকসোর ক্ষেত্রে যে শাস্তি হয়, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সেই একই শাস্তি হয় না। প্রেক্ষাপটটাই ভিন্ন। এটা যে প্রশাসন জানে না তা নয়। কিন্তু তার পরেও যখন এতটা তৎপরতার সঙ্গে রাজ্য সরকার হাই কোর্টে গেল, তখন বুঝতে হবে নির্দিষ্ট কোনও ভাবনা থেকেই গিয়েছে।’’
তৃতীয়ত, আরজি কর আন্দোলন মূলত শহর এবং মফস্সলকে আলোড়িত করেছিল। যে মহিলা ভোট তৃণমূল কার্যত পুঁজিতে পরিণত করেছে, সেই মহিলা মননেও ‘ক্ষত’ তৈরি করেছিল আরজি করের ঘটনা। সঞ্জয়ের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে রাজ্য সরকার যে আগ্রাসী ভঙ্গিতে হাই কোর্টে মামলা দায়ের করেছে, তা সেই মহিলা মননের প্রতি ‘সহমর্মিতা’ হিসাবেও ব্যাখ্যা করছেন অনেকে।
যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূল এত ব্যাখ্যার পথে হাঁটেনি। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিন থেকে এই ঘৃণ্য অপরাধে ফাঁসি চেয়েছিলেন। আদালতের রায়ে তা হয়নি। তাই রাজ্য সরকার আইন মেনেই উচ্চ আদালতে ফাঁসির আবেদন জানিয়ে মামলা করেছে।’’ তবে বিরোধীরা মনে করছে এর নেপথ্যে ‘ফিকির’ রয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘কলকাতা পুলিশ শুরু থেকে তদন্তে এই তৎপরতা দেখায়নি। এখন রাজ্য সরকার কেন এমন বিদ্যুৎগতিতে ফাঁসি চেয়ে হাই কোর্টে গেল, কোন চাপে গেল, তারও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এই কারণেই আমরা প্রথম থেকে বিচারবিভাগীয় তদন্ত চেয়েছিলাম।’’ বিজেপির মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘এই মামলার গোড়া থেকেই আমরা বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কথা শুনছি। কারণ, ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার সঙ্গেই রয়েছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের বিপুল দুর্নীতি। সেই তদন্ত এখনও চলছে। তার মধ্যেই সঞ্জয়ের ফাঁসির জন্য এত তৎপরতা কেন? এ-ও একটা বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ।’’