কুন্তল ঘোষ এবং শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
দু’জনেই রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের যুব নেতা। হুগলির বলাগড় এলাকায় বাড়ি দু’জনেরই। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত হুগলির যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষকে তিনি আদপেই চেনেন না বলে টানা জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ক্রমাগত দাবি করে চলেছেন অন্য যুব নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। অস্বীকার করছেন ওই দুর্নীতিতে তাঁর সংস্রবের কথাও।
অথচ ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট সূত্রের অভিযোগ, ২০১৪ থেকে অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে চতুর্থ বর্ষ থেকেই নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত শান্তনু ও কুন্তল। এবং প্রাথমিক তদন্তে ইডি জেনেছে, নিয়োগ দুর্নীতিতে শান্তনু ছিলেন কুন্তলের ‘মেন্টর’। বাঁকা পথের কোন কাজটা কে করবে, বোঝাপড়ার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে সেটাও ঠিক করে নিয়েছিলেন ওই দুই যুব নেতা। ইডি সূত্রের দাবি, মূলত প্রভাবশালী লোকেদের সঙ্গে লেনদেনের দায়িত্বে ছিলেন শান্তনু। আর যাঁদের জন্য এবং যাঁদের দিয়ে টাকা তোলার কাজটা চলত, সেই কর্মপ্রার্থী ও এজেন্টদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভার ন্যস্ত ছিল কুন্তলের উপরে। এই কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত, বেসরকারি কলেজ সংগঠনের নেতা তাপস মণ্ডলের দাবি, শান্তনুর সঙ্গে কুন্তলই তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তাপসের অভিযোগ, ‘পিছনের দরজা’ দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করার জন্য তাঁর চেনাজানা বহু প্রার্থীর কাছ থেকে ১৯ কোটিরও বেশি টাকা নিয়েছেন কুন্তল। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, যাবতীয় অভিযোগ যাচাই করা হচ্ছে।
ইডি সূত্রের খবর, গত শুক্রবার হুগলির বলাগড়ে শান্তনুর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত বহু নথি উদ্ধার হয়েছে। তার পরেই আয়কর রিটার্ন এবং তাঁর বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথি-সহ শান্তনুকে পরপর তলব করা হয়। তাঁকে বুধবার প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। ওই দিন তাঁকে কুন্তল-তাপসের মুখোমুখি বসিয়েও প্রশ্ন করা হয়। বৃহস্পতিবার, প্রজাতন্ত্র দিবসেও তাঁকে ডেকে কুন্তলের সঙ্গে বসিয়ে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ চলে। রাত পর্যন্ত শান্তনু ইডি দফতরে ছিলেন।
তদন্তকারীদের দাবি, কুন্তল ও তাপসকে চিনতে অস্বীকার করছেন শান্তনু। প্রথম থেকেই ওই যুব নেতা সমানে দাবি করে আসছেন, কুন্তল বা তাপসের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু কুন্তল ও তাপস দু’জনেই তদন্তকারী অফিসারদের কাছে দাবি করেন, শান্তনু তাঁদের পূর্বপরিচিত, নিয়োগ দুর্নীতিতে তিনিও জড়িত।
তদন্তকারীদের কথায়, নিয়োগ দুর্নীতিতে তিনি কোনও ভাবেই জড়িত নন, এটা প্রমাণ করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে গিয়ে কুন্তল ও তাপসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এড়িয়ে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন শান্তনু। ইডি-র দাবি, শান্তনুর সঙ্গে কুন্তলের যোগসাজশের বহু তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। জেরায় শান্তনুর বিরুদ্ধে বহু তথ্যের হদিস দিয়েছেন কুন্তল। ইডি সূত্রের দাবি, শান্তনুকে তিনি দফায় দফায় টাকা দিয়েছেন বলে কুন্তল জেরার মুখে জানিয়েছেন। এ দিনেও মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে শান্তনুর সামনে নিয়োগ দুর্নীতির নানা তথ্য দিয়েছেন কুন্তল।
ইডি সূত্রের দাবি, কুন্তলেরা যে ২০১৪ সালের শেষ দিকে কসবা থানা এলাকায় একটি অফিস খুলে এজেন্ট মারফত এসএসসি বা স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতির মাধ্যমে দেদার টাকা তুলেছেন, তার নানা তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে এসেছে। ২০১৪ সাল থেকেই প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কুন্তল ও শান্তনুর যোগাযোগ ছিল। দুর্নীতিতে নেওয়া টাকার বড় অংশ তিনি পার্থকে দিয়েছিলেন বলে কুন্তলের দাবি।
ইডি জানিয়েছে, কুন্তল ও শান্তনুকে মুখোমুখি বসিয়ে বাকি এজেন্টদের খোঁজখবর জানার চেষ্টা চলছে। গোপাল দলপতি নামে তাপসের পরিচিত এবং কুন্তল-ঘনিষ্ঠ এক এজেন্ট নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থার মামলায় সেই গোপাল এখন তিহাড় জেলে বন্দি। আরও কয়েক জন এজেন্টের হদিস দিয়েছেন তাপস। ওই এজেন্টরা যে কুন্তল ও শান্তনুর ঘনিষ্ঠ, সেই তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তাঁদের দাবি, কুন্তল এজেন্ট ও চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে এবং শান্তনু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দুর্নীতি চালিয়েছেন।
বুধবার শান্তনুকে বেলা ১১টা থেকে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত প্রশ্ন করা হয়েছিল। প্রথমে শুধু তাঁকে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী অফিসার। পরে তাঁকে কুন্তল ও তাপসের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়। মাঝরাত পর্যন্ত চলে প্রশ্ন পর্ব। এর আগে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে শান্তনু জানিয়েছিলেন, তিনি কুন্তলকে চেনেন। এ দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢোকা এবং বেরোনোর সময় অবশ্য সংবাদ মাধ্যমের কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি।