নিজের টালির চালের কাঁচা বাড়ির সামনে দিনমজুর কার্তিক রায়। ছবি: সুজিত মাহাতো।
সম্বল বলতে সামান্য চাষজমি। কারও সেটুকুও নেই। অথচ আবাস প্রকল্পের পোর্টালে ভুলের জন্য তাঁরা প্রত্যেকেই পাঁচ একর করে সেচ-সেবিত দোফসলি জমির মালিক হয়ে গিয়েছেন। আর সরকারি পোর্টালের ভুলের মাসুল গুনে, জীর্ণ কাঁচাবাড়িতে বাস করেও আবাস প্রকল্পের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন পুরুলিয়া ১ ব্লকের লাগদা পঞ্চায়েতের ১৯৯ জন বাসিন্দা।
পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের দাবি, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি থেকে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জানিয়েও ভুল সংশোধন করা যায়নি। ফলে, ওই দুঃস্থ পরিবারগুলি এ বার রাজ্যের আবাস প্রকল্পে বঞ্চিত থেকে গেলেন। তবে অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) রাণা বিশ্বাস আশ্বাস দিয়েছেন, “লাগদা পঞ্চায়েতের ওই সমস্যাটি জেলা প্রশাসনের নজরে রয়েছে। আবাসের পোর্টালটি কেন্দ্রের। জেলা প্রশাসন তাই সংশোধন করতে পারে না। সমস্যার সমাধান চেয়ে রাজ্য প্রশাসনকে সম্প্রতি চিঠি দেওয়া হয়েছে।”
ভুলের জেরে আবাস থেকে নাম বাদ পড়া লাগদা পঞ্চায়েতের রায়বাঘিনী গ্রামের দিনমজুর কার্তিক রায়ের দাবি, “সামান্য চাষের জমিও নেই। অথচ সরকারি পোর্টালে আমিই নাকি পাঁচ একর সেচ-সেবিত জমির মালিক! তা হলে কি আর দিনমজুরি করতে হত?” ওই গ্রামের তপন রায়ের বিধবা স্ত্রী শীতলার অল্প যেটুকু জমি রয়েছে, তাতে বৃষ্টি হলে তবেই সামান্য আমন ধান চাষ হয়। আবাসের পোর্টালে তিনিও পাঁচ একর সেচ-সেবিত জমির মালিক! শীতলা বলেন, “অভাবের কারণে দুটো মেয়ে পড়া ছেড়েছে। ছেলে দিনমজুরি করে। তাও বলছে, আমাদের নামে পাঁচ একর করে জমি আছে বলে আবাসের তালিকা থেকে নাম বাদ পড়েছে। এ কেমন অনাচার!” রায়বাঘিনীর কৈলাস রায়েরও সামান্য জমিতে মাস পাঁচেক খাওয়ার মতো ধান চাষ হয়। পুজোপাঠই তাঁর প্রধান ভরসা। তিনিও বলেন, “কী করে যে পাঁচ একর জমির মালিক হলাম, কে জানে।”
রায়বাঘিনীর ২২ জনের একই সমস্যা। পাশের চাকড়া গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জয় সহিসও জানিয়েছেন যে, তাঁর মায়ের নাম আবাসের তালিকায় থাকলেও পরে একই কারণে বাদ গিয়েছে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের সদস্য শ্যামসুন্দর গোপের কথায়, “মাহালিতোড়া-চকঝরিয়া সংসদের ৩৬ জনের নাম পোর্টালে ভুল তথ্যের কারণে বাদ পড়েছে।”
কী করে ভুল হল?
লাগদা পঞ্চায়েতের প্রধান ময়ূরবাহন ঘোষাল জানান, ২০১৮ সালে আবাস প্রকল্পের যে তালিকা তৈরি হয়েছিল, সেখানে চাকড়া, বেলকুঁড়ি ও মাহালিতোড়া-চকঝরিয়া সংসদের ১৯৯ জনের নাম ছিল। হঠাৎ পোর্টাল থেকে তাঁদের নাম উড়ে যায়। ব্লক অফিস জানায়, পোর্টালে দেখাচ্ছে, তাঁরা প্রত্যেকেই পাঁচ একর করে সেচ-সেবিত দোফসলি জমির মালিক! অথচ বাস্তবে তাঁদের অধিকাংশ দিনমজুর, কেউ বা প্রান্তিক চাষি। তাঁদের বেশিরভাগই আবাস প্রকল্পে বাড়ি পাওয়ার যোগ্য। প্রধানের কথায়, “গোটা পঞ্চায়েত এলাকায় দোফসলি বা সেচ-সেবিত জমি নেই। আর এত কৃষিজমি গোটা পঞ্চায়েত এলাকাতেই রয়েছে কি না সন্দেহ। কী করে এই ভুল তথ্য উঠল, আমরাও জানি না।”
এই তথ্য সামনে আসার পরে পঞ্চায়েতের তরফে ব্লক ও জেলা প্রশাসনের কাছে সংশোধনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। লাভ হয়নি। প্রধানের দাবি, লোকসভা ভোটের আগে তাঁদের পঞ্চায়েতের কাজ সরেজমিনে দেখতে আসা কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদেরও সমস্যাটি জানানো হয়েছিল। তালিকা ধরে তাঁরা দু’-একটি জায়গা পরিদর্শন করে ভুল যে হয়েছে তা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু সংশোধন আর হয়নি। তাঁর মতে, “এই ভুলের তদন্ত করা প্রয়োজন।”
বিডিও (পুরুলিয়া ১) মনোজকুমার মাইতি বলেন, “লাগদা পঞ্চায়েতের ১৯৯ জনের নাম আবাস প্লাস প্রকল্পের তালিকায় থাকলেও তাঁরা প্রত্যেকে পাঁচ একর করে জমির মালিক বলে পোর্টালে দেখা যাচ্ছে। তাই নাম বাদ পড়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান বিষয়টি জানিয়েছেন। আমি ফের জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। যান্ত্রিক কোনও কারণে এই ত্রুটি বলে মনে হচ্ছে।”