সংস্কার করা জোড়বাংলো মন্দিরের উপরেই উঠে পড়েছেন পর্যটকেরা। ছবি: সঙ্গীত নাগ।
লক্ষ্য ছিল গড়পঞ্চকোটের সমস্ত স্থাপত্যের সংস্কার করে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থা চালু করা হবে। কিন্তু আংশিক সংস্কারের কাজেই বরাদ্দ অর্থ শেষ হয়ে গিয়েছে। যেটুকু সংস্কার হয়েছে, তা-ও পর্যটকদের অবাধ গতিবিধিতে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে সংস্কারের দায়িত্বে থাকা রাজ্য হেরিটেজ কমিশন।
রাজা কীর্তিনাথ শিখর আনুমানিক ৯২৬ খ্রিস্টাব্দে পাড়া থেকে নিতুড়িয়া ব্লকের গড়পঞ্চকোট পাহাড়ে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। লোক গবেষদের মতে, ওই পাহাড়ে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজধানী ছিল। ৩২ জন রাজা এখান থেকেই প্রায় আটশো বছর রাজত্ব করেছিলেন। পাহাড়ের দক্ষিণ ভাগে ১২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছিল রাজধানীর ব্যপ্তি। রাজধানীর চার প্রবেশপথে ছিল চারটি তোরণ। পাহাড়ের পাঁচশো ফুট উপরে ছিলো পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মূল দুর্গ। নীচে ছিল অন্দরমহল। যা রানিমহল নামে পরিচিত।
বছর দুয়েক আগে সেগুলি-সহ পাহাড়ের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাছারিবাড়ি, রানিমহল, রাজবাড়ির মূল দুর্গ, রঘুনাথ মন্দির বা রঘুবর মন্দির, দু’টি জোড় বাংলো মন্দির, একরত্ন মন্দির, কল্যাণেশ্বরী মন্দির, কঙ্কালীমাতার মন্দির-সহ আরও কিছু ভগ্নপ্রায় মন্দির সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। প্রায় ৪ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছিল রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর।
সূত্রের খবর, স্থাপত্যগুলির মধ্যে কয়েকটির সংস্কার করতেই বরাদ্দ অর্থ শেষ। গত এক বছর ধরে সংস্কারের কাজ পুরোপুরি বন্ধ। কিন্তু হেরিটেজ কমিশনের মতে, যে স্থাপত্যগুলির সংস্কার করা হয়েছে, সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাহাড়ে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সংরক্ষণ স্থপতি অঞ্জন মিশ্র জানান, গড়পঞ্চকোটে তাঁরা স্থাপত্যগুলির মূল কাঠামো বজায় রেখেই সংস্কার করেছেন। কিন্তু সেই কাঠামো বহু প্রাচীন। ফলে স্থাপত্যগুলির রক্ষণাবেক্ষণের নির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পর্যটকদের অনেকেই সংরক্ষণ করা স্থাপত্যগুলির উপরে উঠে পড়ছেন। বাইক নিয়েও স্থাপত্যগুলির উপরে অনেকে উঠছে। পর্যটকদের গাড়ি স্থাপত্যগুলির কাছে চলে আসছে। চাকায় উড়ে আসা ধুলোর আস্তরণ পড়ছে স্থাপত্যগুলিতে। যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। রানিমহলের সামনে তৈরি হওয়া ছোটবড় প্রচুর দোকানও উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
অঞ্জনের কথায়, ‘‘ইতিহাস-নির্ভর পর্যটন কেন্দ্র আর চড়ুইভাতি করার জায়গা এক নয়।এটাই বোধহয় গুলিয়ে যাচ্ছে। সংরক্ষণ করা স্থাপত্যগুলিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তাই নিয়ন্ত্রিত পর্যটন গড়া একান্তই প্রয়োজন।”
সহমত জেলার লোকগবেষক সুভাষ রায়ও। তিনি বলেন, ‘‘বহু প্রতীক্ষার পরে গড়পঞ্চকোটের মন্দির, রাজবাড়ি, রানিমহল-সহ মন্দিরগুলির সংস্কার শুরু হয়েছিল।কিন্তু সব ক’টির সংস্কার করা যায়নি। যেগুলির কাজ হয়েছে, সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ না করা গেলে ওই পাহাড়ে শিখর রাজবংশের ইতিহাস হারিয়ে যাবে।’’
কিন্তু সংরক্ষণ করবে কে? অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) রাজেশ রাঠৌর জানান, গড়পঞ্চকোটের স্থাপত্যগুলির সংরক্ষণ ও সংস্কার হয়েছে। তবে পাহাড়ে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন গড়া নীতি বিষয়ক ব্যাপার। সেই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লক প্রশাসন পাহাড়ে স্থাপত্যগুলির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবে।’’
যদিও নিতুড়িয়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শান্তিভূষণপ্রসাদ যাদবের দাবি, ‘‘স্থাপত্যগুলি সংস্কারের কাজ চলার সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বা প্রশাসন পঞ্চায়েত সমিতিকে কিছুই জানায়নি। আমরা শুধু শুনেছি কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনও প্রশাসন আমাদের সেই কাজ সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়নি। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিলে সমিতি তখন দেখাশোনা করবে।’’