Inspirational

সন্তান হারিয়েও বিরাম নেই, সাত দশক কালী গড়ছেন সন্ন্যাসী

ভোটার ও আধার কার্ড অনুযায়ী, সন্ন্যাসীর বয়স ছিয়াশি পেরিয়েছে। তার মধ্যে সাতটি পরিবারের সদস্যদের কথায়, আসল বয়স হয়তো আরও কিছুটা বেশিই হবে।

Advertisement
দয়াল সেনগুপ্ত 
দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৩৮
অশিতিপর শিল্পী সন্ন্যাসী সূত্রধর লোবা কালীর মুখ তৈরি করছেন।

অশিতিপর শিল্পী সন্ন্যাসী সূত্রধর লোবা কালীর মুখ তৈরি করছেন।

বয়স থাবা বসিয়েছে। শরীরে আর তেমন জোর নেই। কয়েক মাস আগেই ক্যানসারে বড় ছেলেকে হারিয়েছেন। তাই বলে কি কাজ থামিয়ে দিতে হবে? অশিতিপর সন্ন্যাসী সূত্রধর সে কথা বিশ্বাসই করেন না। তাই এখনও জেলার অন্যতম বিখ্যাত কালী, লোবা-মায়ের মূর্তি গড়ার দায়িত্ব মূলত তাঁরই কাঁধে।

Advertisement

বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর দেখা মিলল লোবা কালীর মন্দিরে। এক মনে কালীর মুখ তৈরি করছিলেন তিনি। অন্য দিকে, খড় ও বাঁশ দিয়ে দেবীর মূর্তি গড়ার কাঠামো তৈরি হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, একাদশীর দিন থেকে মাটি জমিয়ে মূর্তি তৈরি শুরু হয়। এখানে সে কাজ শেষের দিকে। সন্ন্যাসী বলেন, “দেবীর মুখের কাজ শেষ করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। প্রায় সাত দশক ধরে এ কাজ করছি।”

ভোটার ও আধার কার্ড অনুযায়ী, সন্ন্যাসীর বয়স ছিয়াশি পেরিয়েছে। তার মধ্যে সাতটি পরিবারের সদস্যদের কথায়, আসল বয়স হয়তো আরও কিছুটা বেশিই হবে। অন্য মূর্তিগড়ার কাজ থামিয়ে দিলেও লোবার মূর্তি গড়ায় তিনি-ই মূল ভরসা। যে কাজ করতে হলে অনেক নিয়ম মানতে হয়। লোবার পাশের বাবুপুর গ্রাম থেকে প্রতি দিন হেঁটেই লোবাকালী মন্দিরে আসেন মূর্তি গড়তে। এই নিয়ম চলবে কালীপুজোর দিন পর্যন্ত।

প্রবীণ শিল্পী বলেন, বাবা মানগোবিন্দ সূত্রধরের হাত ধরে ১৫-১৬ বছর বয়সে লোবাকালীর মূর্তি তৈরি শুরু করেছিলাম। দৃষ্টিশক্তি এখনও কমে যায়নি। তবে শরীরের জোর কমেছে। তাই সব কাজ করতে পারি না। যেমন কাঠামো তৈরি, ১২ ফুট উচ্চতার লোবা মায়ের চক্ষুদান-সহ অন্য কাজে সাহায্য করে আমাদের পরিবারের সদস্যেরা। সে তালিকায় ওঁর ভাইপোরা আছেন, আছেন নাতিরা। তালিকায় রয়েছেন নাতি সুরজিৎ সূত্রধর (ভাইপোর ছেলে), যিনি লোবা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানও বটে।

সুরজিৎ বলেন, “এখন পুজোর ছুটি রয়েছে। তবে পঞ্চায়েত খুললে মূর্তিগড়ার কাজে হাত লাগাতে দিন কয়েক ছুটি নিতে হবে। তবে লোবা মায়ের মূর্তি গড়ার আসল শিল্পী দাদুই । ওঁর কাছেই যা শেখার শিখেছি।’’

জানা গিয়েছে, শতাব্দী প্রাচীন লোবা কালী পুজোর প্রচলন করেছিলেন রামেশ্বর দণ্ডী নামে উত্তর ভারতের এক সাধক। পরে তা লোবা ঘোষ পরিবারের (বর্তমানে একটি ট্রাস্টও রয়েছ) হাতে রয়েছে। নানা কাহিনী জুড়ে আছে এই পুজোর সঙ্গে। জুড়ে আছে নানা নিয়ম।

জানা গিয়েছে, কালী বিসর্জনের পরে সেই কাঠামো পুকুরের জলেই পড়ে থাকে। দুর্গাপুজোর দশমীর দিন দোলা বিসর্জনের পরে সেই কাঠামো তুলে কালী মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়। একাদশীতে মায়ের মুখ তৈরি শুরু করতেই হবে। এটাই রীতি।

মূর্তি গড়ার লাল মাটি অজয় নদ পেরিয়ে পশ্চিম বর্ধমানের গৌরবাজারের একটি পুকুর থেকে মাথায় করে নিয়ে আসে গ্রামের একটি বাগদি পরিবারের সদস্যেরা। খড়ের কাঠামোর তৈরিতে লাগে বাবুই দড়ি। সেটার জোগান দেন গ্রামের দাস, বাউড়ি পরিবারগুলি। সন্ন্যাসীর হাতে সেই লাল রঙের মাটিতেই মূর্ত হয়ে উঠছে লোবা কালীর মুখ ।

জানা গিয়েছে. কয়েক মাস আগে শিল্পী তাঁর ক্যানসার আক্রান্ত বড় ছেলেকে হারিয়েছেন। তবুও ছেদ পড়েনি কাজে। পুজোর দায়িত্বে থাকা ঘোষ পরিবার তথা স্টেট সেবায়েত কাঞ্চন ঘোষ বলেন, “আমার বয়স ৫৫ বছর। কোন ছোটবেলা থেকেও ওঁকে মূর্তি গড়তে দেখছি।” প্রবীণ শিল্পী বলেন, ‘‘শক্তি কমলে হয়তো মায়ের দয়াই শরীরে এখনও রোগ বাসা বাঁধেনি।”

আরও পড়ুন
Advertisement