Mamata Banerjee’s UK Visit

বক্তৃতার মাঝে পোস্টার তুলে ধরে বিক্ষোভ, শান্ত মমতা বললেন, ‘ভয় দেখাবেন না, মাথা নত করি শুধু জনতার সামনে’

বাকি দর্শকদের সমবেত প্রতিবাদের সামনে বিক্ষোভকারীরা অবশ‍্য বেশি ক্ষণ দাঁড়াতে পারেননি। পোস্টার নিয়ে হল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয় তাঁদের। আর মমতা বলেন, ‘ওঁরা আমায় মিস্ করলেন।’

Advertisement
অনিন্দ্য জানা • অক্সফোর্ড
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫ ০০:৫১
(উপরে) অক্সফোর্ডে বলছেন মমতা। বিক্ষোভকারীরা (নীচে)।

(উপরে) অক্সফোর্ডে বলছেন মমতা। বিক্ষোভকারীরা (নীচে)। —নিজস্ব চিত্র।

সামনের সারিতে বসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর সামনেই গুটিকয় বিক্ষোভকারীকে ‘বাপি বাড়ি যা’ করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

দিলেন নিজের মনকে বশে রেখে, সংযত রেখে। বিক্ষোভকারীদের স্লোগান এবং পোস্টারের সামনে তিনি বললেন, ‘‘আমি আপনাদের সকলকে খুব ভালবাসি। আপনারা আপনাদের পার্টিকে আরও মজবুত করুন। যাতে আমার সঙ্গে তারা লড়তে পারে!’’ পাশাপাশি মনে করিয়ে দিলেন, দেশের প্রতিনিধি হয়েই তিনি বিলেতে এসেছেন, অক্সফোর্ডে বক্তৃতা করছেন। বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘আমাকে অপমান করছেন করুন। দেশকে অপমান করবেন না।’’ মমতার উদ্দেশে যখন বিক্ষোভকারীরা পোস্টার দেখাচ্ছেন, তখন মমতাও পোডিয়াম থেকে পাল্টা পোস্টার দেখান। তাতে তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করা ছবি। ১৯৯০ সালের ১৬ অগস্ট হাজরা মোড়ে মমতার উপর যে হামলা হয়েছিল, পরের দিনের সংবাদপত্রে ওই ছবিটিই প্রকাশিত হয়েছিল। মমতা যখন ওই ছবি তুলে ধরছেন, তখন বিক্ষোভকারীদের দিক থেকে বলা হয়, ‘‘নাটক! নাটক!’’ পাল্টা মমতা বলেন, ‘‘কোনও নাটক নয়। এটাই ঘটনা।’’

বিক্ষোভের মুহূর্ত।

বিক্ষোভের মুহূর্ত। —নিজস্ব চিত্র।

বাকি দর্শকদের সমবেত প্রতিবাদের সামনে বিক্ষোভকারীরা অবশ‍্য বেশি ক্ষণ দাঁড়াতে পারেননি। পোস্টার নিয়ে হল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয় তাঁদের। আর মমতা বলেন, ‘‘ওঁরা আমায় মিস্ করলেন।’’ তার পরে বললেন জনপ্রিয় ইংরেজি গানের দু’লাইন, ‘ইফ ইউ মিস্ দ‍্য ট্রেন অ‍্যাম অন, ইউ উইল নো দ‍্যাট আই অ‍্যাম গন! ইউ ক‍্যান হিয়ার দ‍্য হুইসল ব্লো আ হানড্রেড মাইলস।’

সভাকক্ষের পিছন থেকে প্রথম যখন বিক্ষোভমিশ্রিত প্রশ্ন উঠছে, তখন উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন রাজ্যের প্রাক্তন ও প্রয়াত মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের কন্যা শ্রেয়া পাণ্ডে। তিনি বলতে থাকেন, ‘‘এটা কোনও সাংবাদিক সম্মেলন নয় যে আপনারা প্রশ্ন করবেন।’’ কিন্তু প্রশ্ন তাতে থামেনি। এক প্রৌঢ় মমতার উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘‘আপনি মিথ্যা বলছেন।’’ মমতা উত্তর দেন, ‘‘নাহ্ ব্রাদার, আমি কোনও মিথ্যা বলছি না।’’ এর পর চিৎকার বাড়তে থাকে। সেই সময়ে শিল্পপতি সিকে ধানুকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে। ধানুকাকে শান্ত করতে মমতা বলেন, ‘‘বলতে দিন না। গণতন্ত্রে বিরুদ্ধ স্বর তো উঠবেই।’’ একেবারে সামনের সারিতে বসে থাকা সৌরভও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলেন কী হচ্ছে। তার পর শ্রোতাদের বড় অংশ পাল্টা চিৎকার শুরু করেন বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে। শুরু হয় বিতণ্ডা। পরে মমতা বলেন, ‘‘আমি মানসিক ভাবে তৈরি হয়েই এসেছিলাম।’’

৩৫ বছর আগে মার খেয়ে আহত বিরোধী নেত্রী মমতার ছবি তুলে দেখাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।

৩৫ বছর আগে মার খেয়ে আহত বিরোধী নেত্রী মমতার ছবি তুলে দেখাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ছবি: সংগৃহীত।

আরজি কর প্রসঙ্গ উঠলে তিনি যে ব‍্যাট চালাবেন, সেটা বুধবারেই বলে রেখেছিলেন মমতা। যা বলেছিলেন, করলেনও তেমনই। তবে শান্ত ভাবে। তাঁকে যখন চিৎকার করে ‘মিথ‍্যাবাদী’ বলা হচ্ছে, যখন ‘অভয়াকে খুন করেছেন’ বলা হচ্ছে, তখনও মমতা বলছেন, ‘‘ইউ আর মাই সুইট ব্রাদার। আই লভ ইউ অল। প্লিজ় শান্ত হোন। আমি আপনাদের মিষ্টি দেব।’’ এর পরে মমতা এ-ও বলেন, ‘‘আমার বাম, অতিবাম, সাম্প্রদায়িক শক্তির বন্ধুদের বলব, আপনাদের আমি চকোলেট দেব। আপনাদের মতাদর্শকেও চকোলেট খাওয়াব।’’

তার কিছু ক্ষণ পরে, যখন সমবেত পাল্টা প্রতিরোধের মুখে বিক্ষোভ মিইয়ে আসছে তখন কিছুটা চ্যালেঞ্জের সুর, ‘‘আমি বছরে দু’বার করে অক্সফোর্ডে আসব। যত বার বলবেন, তত বার আসব। আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমায় ভাল করে কোনও কাজ করে দিতে বললে ঘর মুছে, কাপড় কেচে, রান্না করে বা বাসন মেজে দিতে পারব। কিন্তু ভয় দেখালে হবে না। আমি ভয় পাই না। আমি আমার মাথা নত করি একমাত্র জনতার সামনে। আর কারও সামনে নয়।’’

তবে বিক্ষোভকারীদের রকমসকম দেখে অনেকে মনে করছেন, তাঁরা এসেছিলেন মমতার বক্তৃতা ভন্ডুল করতেই। প্রশ্ন করতে নয়। মমতা তা করতে দেননি। তিনি বক্তৃতা থামাননি। শান্ত এবং সংযত কণ্ঠে কথা বলেছেন। সেখানেই তাঁর জিত দেখছেন অনেকে।

শান্ত ভাবেই বক্তৃতা শেষ করেন মমতা।

শান্ত ভাবেই বক্তৃতা শেষ করেন মমতা। —নিজস্ব চিত্র।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলগ কলেজ মমতাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বিষয় ছিল ‘সামাজিক উন্নয়ন: নারী, শিশু ও প্রান্তিক অংশের উন্নয়ন’। তাঁর কাছে যাহা অক্সফোর্ড তাহাই বিধানসভা, যাহা কেলগ কলেজ তাহাই কলকাতা— সেই মতো নিজস্ব ঢঙেই বক্তৃতা শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী। ইংরেজি বক্তৃতার মধ্যেই বার বার বাংলায় ‘মা-মাটি-মানুষ, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী’ উচ্চারিত হচ্ছিল। বেশ কিছু ক্ষণ পর প্রসঙ্গক্রমে মমতার বক্তৃতায় আসে কলকাতায় এখনকার তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের বিনিয়োগের কথা। আসে টাটা গোষ্ঠীর নামও। টাটার নাম উচ্চারিত হতেই সভাঘরের একেবারে পিছন থেকে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিক্ষুব্ধ কলরবের আকার নেয়। দর্শকাসনের বাকিরা দাঁড়িয়ে পড়েন। কিন্তু মমতা ছিলেন সংযত। দেখা যায় যে, হাতেগোনা কয়েক জন পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। মমতা যখন তাঁদের জবাব দিচ্ছেন তখন করতালিতে ফেটে পড়ছিল সভাকক্ষ। অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, যাঁরা গোলমাল করেছেন, তাঁরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বা গবেষক নন। সকলেই বহিরাগত। কর্তৃপক্ষের তরফে গোটা ঘটনার জন‍্য বারংবার মমতার কাছে দুঃখপ্রকাশও করেছেন। অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে কলকাতায় ক্যাম্পাস তৈরির আর্জি জানান মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনারা যে দিন ‘হ্যাঁ’ বলবেন, পরের দিনই আমি জমির ব্যবস্থা করে দেব। পরিকাঠামোগত সমস্ত দায়িত্বও আমাদের।’’

বৃহস্পতিবার মমতার বক্তৃতা শুনতে অনেক প্রবাসী এসেছিলেন অক্সফোর্ডে। এসেছিলেন স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বসার জায়গা তো খালি ছিলই না উপরন্তু একেবারে শেষে দাঁড়িয়ে মমতার বক্তৃতা শোনেন অনেকে। ভাষণ, প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে মমতাকে ঘিরে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। লন্ডনে ফেরার উদ্দেশে যখন মমতা বাসে উঠে পড়েছেন, দেখা গেল বহু মানুষ সেই বাস ঘিরে ছবি তুলছেন।

তবে বিক্ষোভ দেখালেন কারা? তাঁদের পরিচয় কী? তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। বিক্ষোভকারীদের এক জনের কপালে লাল তিলক কাটা ছিল। ‘ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস’ বিরোধী পোস্টার ছিল। যা দেখে অনেকের অনুমান, নেপথ্যে বিজেপি থাকতে পারে। আবার বিক্ষোভকারীদের মধ্যে থেকে যখন মমতার উদ্দেশে বলা হচ্ছিল, ‘আপনি যাদবপুরে আসুন’, তা দেখে অনেকের মনে হয়েছে তাঁরা অতিবাম মনোভাবাপন্ন। মমতা টাটা গোষ্ঠীর কথা তোলার পর যে ভাবে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, তাতে অনেকে মনে করছেন এতে সিপিএম ছিল। এই সব মনে হওয়াতেই আপাতত সীমাবদ্ধ। বিক্ষোভকারীদের সার্বিক পরিচয় এখনও পুরোটা স্পষ্ট নয়। তবে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের ব্রিটেনের শাখা স্বীকার করে নিয়েছে যে, তাদের লোকজন বিক্ষোভে ছিল।

তবে গোটা অনুষ্ঠানে বিক্ষোভের প্রভাব অল্পই। কেলগ কলেজের প্রেসিডেন্ট জোনাথন মিকি অনুষ্ঠানের সূচনা করে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করার পরেই পোডিয়ামে ডেকে নেওয়া হয় মমতাকে। ছিলেন কেলগেরই কৃতী গবেষক লর্ড কর্ণ বিলিমোরিয়া। বক্তৃতার শেষে তিনিই মমতাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন। প্রথম প্রশ্নটি ছিল অধ্যাপিকা মুকুলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো। মমতার উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন ছিল, তিনি এত এনার্জি (উদ্যম) পান কোথা থেকে? বিলিমোরিয়া বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেন, আপনি নাকি প্রতি দিন ৬০ হাজার স্টেপ হাঁটেন? মমতা জবাব দিতে গিয়ে প্রথমে বলেন, ‘‘আপনার মা-মাটি-মানুষই আমার প্রেরণা।’’ তার পরেই খানিক হালকাচ্ছলে, ‘‘আমার পদবি ব্যানার্জি, তাই এত এনার্জি।’’ গোটা হল তখন মুখ্যমন্ত্রীর কথায় হেসে ওঠে। যা দেখে বোঝারই উপায় নেই, কয়েক মিনিট আগেই একদল লোক এই হলেই হল্লা করছিল।

বক্তৃতা শেষের পর চলছে সাক্ষাৎকার।

বক্তৃতা শেষের পর চলছে সাক্ষাৎকার। —নিজস্ব চিত্র।

মমতা নিজেই কিছু ক্ষণের গুমোট পরিবেশ কাটিয়ে দেন। তার পরেও একাধিক প্রশ্ন আসে মমতার উদ্দেশে। রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অমিত মিত্র-প্রেরিত উন্নয়নের রেখচিত্র দেখিয়ে গবেষক বিলিমোরিয়া জিজ্ঞাসা করেন, কী ভাবে সম্ভব হল? ১১ কোটির রাজ্য, পাহাড়-জঙ্গল রয়েছে, হলটা কী ভাবে? জবাবে মমতা বলেন, ‘‘এগুলো ওঁদের (বিক্ষোভকারীদের) একটু দিয়ে দিন।’’ যদিও তত ক্ষণে তাঁরা সভাকক্ষ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। মমতা এ-ও বলেন, ‘‘আমি মনে করি কোনও কাজই কঠিন নয়। শুধু পজ়িটিভ ভাবনা ভাবতে হয়। নেগেটিভ ভাবনা সব শেষ করে দেয়। আর হিংসার কোনও ওষুধ হয় না। হিংসার চেয়ে ভালবাসা অনেক শক্তিশালী।’’

Advertisement
আরও পড়ুন