West Bengal Panchayat Election 2023

বুথের পর বুথে কেন রইল না কেন্দ্রীয় বাহিনী? কার দায়? কমিশন না কেন্দ্রের? জবাব চাইবে হাই কোর্ট?

হাই কোর্টের নির্দেশ ছিল সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হবে। কিন্তু দিনভর ভোট চললেও সব বুথ তো দূর অস্ত, বেশির ভাগ বুথেই দেখা মেলেনি কেন্দ্রীয় বাহিনীর, এমনই অভিযোগ বিরোধীদের।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩ ২৩:১১
An image of Force

বাহিনী নিয়ে দায় ঠেলাঠেলি কেন্দ্র-কমিশনের। ছবি: পিটিআই।

দৃশ্য এক

স্থান— হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের মহিয়াড়ি-২ পঞ্চায়েত, তিন বুথের কিবরিয়া গাজি হাই স্কুল

Advertisement

সকাল থেকেই ভোটদানের ভিড়। কিন্তু দেখা নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জন জওয়ানেরও।

দৃশ্য দুই

স্থান— উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার বেড়গুম-১ পঞ্চায়েতের ঝনঝনিয়া এফপি স্কুলে ১৮০ ও ১৮১ নম্বর বুথ

দেখা নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জন জওয়ানেরও। এখানেও ভোটদাতাদের ভিড় সকাল থেকেই।

দৃশ্য তিন

স্থান— নন্দীগ্রামের তারাচাঁদবাড় বুথ

দেখা নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর। প্রতিবাদে বুথে তালা স্থানীয়দের।

খণ্ডচিত্রে স্পষ্ট কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা পাননি এই বুথগুলির ভোটদাতারা। অথচ কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ ছিল সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের। শুধু এই তিনটি জায়গাই নয়, বাঁকুড়া থেকে পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে কোচবিহার— কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা পাওয়া যায়নি প্রায় সারা দিনই। তা হলে শনিবার পর্যন্ত যে ৬৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে এল, তাঁরা কোথায় গেলেন! কমিশন জানিয়েছিল, ৪,৮৩৪টি স্পর্শকাতর বুথ-সহ কমবেশি ১৫ হাজার ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা ছিল তাদের।

শুক্রবার রাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কোঅর্ডিনেটর বিএসএফের আইজি এসসি বুদাকোটি লিখিত ভাবেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রতি ভোটকেন্দ্রেই চার জন করে জওয়ান (হাফ সেকশন) মোতায়েনের পক্ষপাতী তাঁরা। সেই নিরিখে রাজ্যের মোট ৪৪,৩৮২টি ভোটকেন্দ্রের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজনীয় সদস্য দরকার নিদেনপক্ষে এক লক্ষ ৭৮ হাজার। প্রতি ভোটকেন্দ্রে দু’জন করে সদস্য রাখতে গেলেও দরকার ৮৮ হাজারের বেশি। এই পরিস্থিতিতে আদালতের নির্দেশ মেনে কী ভাবে প্রতি ভোটকেন্দ্রে বাহিনী মোতায়েন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিরোধীরা।

সাধারণ নিয়ম বলে, একটি বা দু’টি বুথের ভোটকেন্দ্রে ‘হাফ সেকশন’ মোতায়েন করা হয়ে থাকে। কার্যকরী এক সেকশন (আট জন) থাকে তিন এবং চার বুথের ভোটকেন্দ্রে। পাঁচ, ছয় বুথের ভোটকেন্দ্রে দেড় সেকশন (১২ জন) এবং সাত বা তার বেশি ভোটকেন্দ্রে দুই সেকশন (১৬ জন)। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল বেশির ভাগ বুথেই চিহ্ন নেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ভোট শুরুর ঘণ্টা দুয়েক পরের হিসাব বলছে, বাঁকুড়ার ৩,১০০টি বুথের মধ্যে মাত্র ৭৫৭টি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মিলেছে। অর্থাৎ ২,৩৪৩টি বুথ ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীহীন।

এখন প্রশ্ন হল, এমনটা হল কেন? নিজের মতো করে তার জবাব দিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। শনিবার পর্যন্ত ৬৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে এসে পৌঁছতে পেরেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর আসতে এত দেরি হল কেন? আমরা তো বাহিনী চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম ২২ জুন। তার পর মনেও করিয়েছিলাম বেশ কয়েক বার। তা সত্ত্বেও ৪৮৫ কোম্পানি বাহিনী দিতে জুলাই মাসের ৩ তারিখ হয়ে গেল! আমার মনে হয় আরও কিছু আগে বাহিনী এলে সুবিধা হত।’’

অবশ্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের এই বিবৃতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার জবাব আসে দিল্লি থেকে। তাতে পাল্টা দায় চাপানো হয় কমিশনের উপরেই। ভোট শেষ হওয়ার পরে জারি করা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পাল্টা বিবৃতিতে দাবি করা হল, কেন্দ্রীয় বাহিনী আসতে দেরি হয়েছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতা না পাওয়ার কারণেই। বিবৃতিতে তা বিশদে বর্ণনাও করে অমিত শাহের মন্ত্রক। বিবৃতিতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের জন্য দেরিতে অনুরোধ করেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সাধারণত বাহিনীর জন্য ট্রেনের বন্দোবস্ত এবং অন্যান্য ব্যবস্থা করতে সময় লাগে। রাতারাতি তা করা যায় না। এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার জন্য তাদের কোথায় ট্রেন থেকে নামতে হবে বা কোথায় পৌঁছতে হবে সেই সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রয়োজন হয়। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত সেই তথ্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানায়নি। বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, তার বদলে বাহিনীর কো অর্ডিনেটরদের বলে দেওয়া হয় এ বিষয়ে জানতে হলে জেলাশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যা করতে অতিরিক্ত সময় লেগেছে। উদাহরণ দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, উত্তরবঙ্গে যে বাহিনী মোতায়েন করার কথা ছিল, তাদের উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আনানো যেত। তাতে তারা সহজে এবং কম সময়ে উত্তরবঙ্গে পৌঁছতে পারত। কিন্তু যে হেতু কোথায় যেতে হবে, তা অজানা ছিল, তাই প্রথমে বাহিনীকে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে কলকাতায় আনা হয়। তার পর তাঁদের কোথায় মোতায়েন করা হবে তা জেনে পাঠানো হয় উত্তরবঙ্গে। যার ফলে শুধু যাতায়াতেই অতিরিক্ত দু’দিন সময় লেগে গিয়েছে। এর পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুক্তি, কিছু বাহিনীর শনিবার সন্ধ্যাতেও পৌঁছনোর কথা বাংলায়। নোডাল অফিসার কমিশনকে বলেছিলেন, এই বাহিনীকে স্ট্রংরুম পাহারার জন্য ব্যবহার করা হোক। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি কমিশন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কিছু বাহিনীকে স্ট্রং রুমের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করতে রাজি হয়নি কমিশন। শাহের মন্ত্রকের দাবি, যে সমস্ত বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল, সেখানে অশান্তি হয়নি। বরং কোনও বুথ দখলের ঘটনা দেখলেই কড়া হাতে তা দমন করতেও সফল হয়েছে বাহিনী।

যে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে শুরু থেকে এত টানাপড়েন, খাতায়কলমে বাহিনী এলেও কার্যক্ষেত্রে তার দেখাই পেলেন না গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে যাওয়া গ্রামীণ বঙ্গের লক্ষ লক্ষ ভোটাদাতা। কেন বাহিনী নেই, কোথায় গেল বাহিনী, তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মধ্যে চাপান-উতোর তুঙ্গে। কিন্তু প্রশ্ন হল বাহিনী নিয়ে দায় ঠেলাঠেলির শেষ কোথায়?

আরও পড়ুন
Advertisement