Wall Collapse

প্রজাপতির মৃত্যু

ঘাসফুলে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতিদেরও না। কেন দেখতে পাচ্ছে না? তার মনে হচ্ছিল, সে কি অন্ধ হয়ে গেল?

Advertisement
দেবাশিস চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:৩৬
অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র

অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র

Advertisement

‘‘দেখো, দেখো, ছোট ছোট প্রজাপতি উড়ছে ঘাসফুলগুলোতে। সাদা, হলুদ...। কেমন মনে হচ্ছে, ফুলগুলোই উড়ছে যেন।’’

সে আজ পরেছে গাঢ় জাম রঙের একটা কামিজ। ছেলেটি চেয়ে আছে তার দিকে। ঘাসফুল দেখবে কী! মনে হচ্ছে, সে-ই যেন প্রজাপতি হয়ে উড়ছে। মাঝে মাঝে ছেলেটির মনে হচ্ছে, এক বার তার গৌরী হাতটিকে ধরে। বা তার আঙুলগুলোয় নিজের আঙুল ছুঁয়ে দেয় জলতরঙ্গ বাজানোর মতো। তাই সে এক বার হাত বাড়াচ্ছে। ফের গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে।

‘‘দেখো, দেখো, ওই যে নদীর চরে কাশফুল ফুটেছে, যেমন ঝোপ হয়ে আছে, তার ফাঁক দিয়ে পানসি নৌকাটা কেমন জল ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছে! ছবির মতো লাগছে, না?’’

সে কিছু দেখতে পায় না। শরতের দুপুরে হঠাৎ একটু মেঘ করেছে এখন। সবটা কালো, তা নয়। একটু ধূসর, এক দিকে আবার সাদা, পেঁজা তুলোর মতো। এর মধ্যে নদীর চরের পাশে দাঁড়িয়ে ওরা। খোলা দিগন্তে তাকিয়ে তার মনে হল, সত্যিই ছবির মতো। এত আনন্দ, এত সুখে ওই একটু ধূসর মেঘ না থাকলে কী চলে!

তবু সে দেখতে পাচ্ছে না। কাশফুল দেখতে পাচ্ছে না। ঘাসফুলে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতিদেরও না। কেন দেখতে পাচ্ছে না? তার মনে হচ্ছিল, সে কি অন্ধ হয়ে গেল? তার কি গাঢ় জামরঙা জামাটি ছাড়া, সঙ্গে সাদাটে সালোয়ারটি ছাড়া, আর কিছু চোখে পড়বে না?

আবারও সে হাত বাড়াল। যদি ছুঁয়ে যায় আঙুলগুলো! আবারও পিছিয়ে এল। থাক। উড়ুক ওই গৌরীর মতো হাত, শ্রীমতীর মতো ডৌলের মুখ, টানা টানা চোখের মেয়েটি। কত দিন তার ওড়া হয়নি! কত দিন তার দেখা হয়নি, চার ধারে এত আনন্দও থাকতে পারে!

ছেলেটি আবার আকাশের দিকে তাকায়। ধূসর মেঘ কি একটু বাড়ল? একটু কি ছায়া ঘনাচ্ছে পাশের বনে বনে? ফিরতে ইচ্ছে করছে না। তবু এখন কি ফেরার পথ ধরা উচিত? ছেলেটি ভাবতে থাকে, এখানে কোনও জঙ্গল নেই। তবু যে জলাজমির পাশ দিয়ে ফিরতে হবে, সে পথ বড় নির্জন। সেই পথে একটা খালি জমি আছে। অর্ধেকটা পাঁচিলে ঘেরা। অর্ধেক দিয়ে মাঠের মতো আদিগন্ত জমিটা দেখা যায়। সেখানেই তো...।

ছেলেটির মাথায় সুকান্ত নেচে ওঠেন: এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে/ এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা...। ছেলেটি আবার তাকায় প্রজাপতির মতো মেয়েটির দিকে। কে বলবে এই মেয়েটি দু’বছর পড়া হয়ে গিয়েছে কলেজে! দেখে মনে হবে, এখনও সেই চোদ্দো-পনেরোর কিশোরী। সে কি এর আগে দেখেনি ঘাসফুলে প্রজাপতি? সে কি এই প্রথম দেখল কাশবন? এত শিশুর মতো করে না মেয়েটা! ছেলেটি ভাবছিল মনে মনে।

ঠিক তখনই প্রথম বাজ ডাকল। ছেলেটি মুখ তুলে দেখল, আঁধার হল মাদার গাছের তলা। ছেলেটি মুখ নামিয়ে দেখল, কালি হয়ে এল দিঘির জল। ছেলেটিকে শিউরে দিয়ে এক পশলা মিঠে বাতাস বয়ে গেল। ছেলেটিকে চমকে দিয়ে মুখে, হাতে দু’-এক ফোঁটা জল ছিটকে এল আকাশ থেকে।

এখানে তো কোনও ছাউনি নেই। কোথায় দাঁড়াবে তারা? কী ভাবে পৌঁছবে গাঁয়ের বাড়িতে? এতটা পথ। ওই জলা জমি। ওই অর্ধেক পাঁচিলের ওপারে সর্বখাকির মাঠ!

ভাবতে ভাবতেই সব দিক তছনছ করে দিয়ে ঝড়টা উঠে এল নদীর উপর থেকে সোজা পারে। নাড়িয়ে দিল ওদের। ছেলেটি জোরে বলে উঠল, ‘‘চলো, চলো, জলদি চলো! বৃষ্টিটা...।’’

কখন যে বিকেল অন্ধকার হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি ছেলেটি। ধুলো উড়ে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল হঠাৎ। গাঢ় জাম রঙের কামিজ সে দেখতে পাচ্ছে না। ঠিক যেমন একটু আগে দেখতে পাচ্ছিল না প্রজাপতিগুলোকে। কাশবনকে। নদীটাকে। ছেলেটির আবার মনে হল, সে কি তা হলে অন্ধ হয়ে গিয়েছে?

মড়মড় করে হাওয়া আর জলের তাণ্ডব ধেয়ে এল তার দিকে। শব্দ করে নদীর পাড়ে থাকা গুটিকয় দোকান হেলে পড়ল। সেগুলোয় কি কেউ নেই? সব ঝাঁপ বন্ধ। সেখানে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই। ছেলেটি আর মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছে না। কোথায় গেল সে? কোথায়?

ছেলেটি এ বারে ভয় পেয়ে গেল। নদীর পার থেকে ঢালু পথে নেমে রাস্তা গিয়েছে তাদের বাড়ির দিকে। সে দিকে ছুটতে শুরু করল সে। জলের তোড়ে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। চশমার কাচ ঝাপসা। ভিজে একশা হয়ে গিয়েছে সে। মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছে, দু’হাত মুখের ধারে জড়ো করে চিৎকার করে মেয়েটিকে ডাকছে। কিন্তু কোনও সাড়া পাচ্ছে না।
ছুটতে ছুটতে ছেলেটির মনে পড়ে যাচ্ছে, সে দিনও এমনই বৃষ্টি ছিল। এই ভাবে সে ছুটছিল। মেয়েটিকে ডাকছিল। কিন্তু ধারেকাছে কেউ যেন সাড়া দেওয়ার নেই। পৃথিবী যেন জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল সেই সময়ে। শুধু...।

ছুটতে ছুটতে সে অর্ধেক পাঁচিলের কাছে চলে এসেছে। ও পাশে জলা জমিটা দেখা যাচ্ছে। আবছা, ঘষা কাচের মতো চোখে যেন সে এক ঝলক দেখল, গাঢ় জামরঙা কামিজের হাত টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক বলশালী পুরুষ। ওড়নাটা উড়ে পড়ে যাচ্ছে জলা-জমিতে। তার মনে হল হঠাৎ, এক জন নয়, একাধিক পুরুষ। তারা যেন গৌরীর মতো হাত, শ্রীমতীর মতো ডৌলের মুখ ওই মেয়েটিকে তুলে নিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে।

পাঁচিলের পাশ থেকে ছিটকে বার হয়ে ছেলেটি জলা-জমির দিকে ছুটতে লাগল। প্রবল বৃষ্টি আর গোধূলির ধূসর রং তার চোখকে ঢেকে দিয়েছে। তবু সে ছুটতে লাগল শব্দ লক্ষ্য করে। শব্দভেদী বানের মতো। এক বার এখানেই, এই পাঁচিলের ও পারে হারিয়ে গিয়েছিল তার ছুঁতে চাওয়া মুহূর্তেরা। আজ আর হতে দেবে না।

———————————

অনেক অনেক রাতে, ঝড়জল থামলে, ছেলেটি বাড়ি ফেরেনি বলে যখন পাড়ার লোক আলো নিয়ে উজিয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে এল জলাজমিটার কাছে, যেন বেড়ি পরিয়ে দিল কেউ তাদের পায়ে। ওই জমিতে, পাঁচিলের ঠিক পাশটিতে ছেলেটি পড়ে আছে। হাতে ওড়না, গাঢ় জামরঙা।


ঠিক যেখানে দশ বছর আগে পড়েছিল মেয়েটি। মুখে পেঁচানো ছিল ওড়না। গাঢ় জামরঙা।

আরও পড়ুন
Advertisement