মৃত তৃণমূল নেতা দুলাল সরকার। —ফাইল চিত্র।
মালদহের তৃণমূল নেতা তথা পুরপ্রতিনিধি দুলাল সরকার ওরফে বাবলাকে (৬২) খুনের পিছনে অন্যতম কারণ জমির কারবার সংক্রান্ত পুরনো বিবাদ। শুক্রবার গভীর রাতে ইংরেজবাজার শহর থেকে মহানন্দাপল্লির অমিত রজক ওরফে অরুণ এবং ঘোড়াপীর ঘোষপাড়ার অভিজিৎ ঘোষকে গ্রেফতারের পরে, এমনই দাবি পুলিশের। পুলিশ সূত্রের খবর, জমি নিয়ে দুলালের অনুগামীদের সঙ্গে অমিত এবং তার দাদা রোহন রজকের পুরনো বিবাদ ছিল। সেই সুবাদে সঙ্গী জুটিয়ে রীতিমতো ছক কষে এই খুন করা হয়েছে বলে দাবি। হত্যাকাণ্ডের ‘প্রধান চক্রী’ রোহনের খোঁজ চলছে। যদিও জেলা রাজনীতিতে দুলাল সরকারের মতো ‘ওজনদার’ নেতা স্রেফ জমি বিবাদের কারণে খুন হবেন, এমন ‘তত্ত্ব’ মানতে নারাজ তাঁর পরিবার এবং স্থানীয় তৃণমূলনেতৃত্বের একাংশ।
ধৃতদের শনিবার ১৩ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন মালদহ জেলা আদালতের বিচারক। জেলা পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব এ দিন বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত পাঁচ জনকে ধরা হয়েছে। তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতারেরচেষ্টা চলছে।’’
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, নিহত দুলালের মহানন্দাপল্লির আবাসন থেকে বড় জোর ১৫০ মিটার দূরে, মালদহ-নালাগোলা রাজ্য সড়কের ধারে অমিত-রোহনদের এক বৃদ্ধা আত্মীয়ের দু’কাঠা জমি-টালির বাড়ি রয়েছে। বর্তমানে সে সম্পত্তির বাজারদর ৭০ লক্ষ টাকার বেশি। দু’বছর আগে, বৃদ্ধা মারা যাওয়ার পরে, জমিটির দখল নিয়ে দুলালের অনুগামীদের সঙ্গে অমিত ও রোহনের বচসা হয়। সে সূত্রে বছরখানেকআগে দু’ভাইকে ‘মারধর’ করা হয় বলে দাবি।
বিধবা মাকে নিয়ে মহানন্দাপল্লি লাগোয়া রেল কলোনির ঝুপড়িতে থাকত অমিত, রোহন। দুধ বিক্রির কারবার করত। সক্রিয় রাজনীতি না করলেও রোহন তৃণমূলের সমর্থক বলে এলাকায় পরিচিত। বছরখানেক আগে দুলাল অনুগামীদের হাতে ‘আক্রান্ত’ হওয়ার পর থেকে দুলালকে খুনের ছক কষা শুরু করে রোহন, অনুমান পুলিশের। জানা গিয়েছে, যে জমি নিয়ে রোহনদের সঙ্গে দুলাল-অনুগামীদের বিবাদ, সেখানে প্রায় পরিত্যক্ত বাড়িতে বসেই খুনেরছক কষা হয়।
পুলিশের হাতে থাকা ভিডিয়ো ফুটেজ (সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার) অনুযায়ী, দুলালের উপরে গুলি চালাতে দেখা গিয়েছে দুই যুবককে। তদন্তকারীদের দাবি, এই মামলায় আগে ধরা পড়া টিঙ্কু ঘোষ এবং রোহনই দুলালের উপরে গুলি চালায়। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল আরও এক যুবক মহম্মদ শামি আখতার। টিঙ্কু ও শামিকে বৃহস্পতিবার রাতেই ধরে পুলিশ। টিঙ্কু এলাকার বাসিন্দা হলেও ভিন্ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করত। অনুমান, সেই সূত্রেই বিহারের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। অন্য দিকে, খুনে ব্যবহার করা আগ্নেয়াস্ত্র ও মোটরবাইক লুকোনোর কাজে অভিযুক্তদের সাহায্য করেছিল অভিজিৎ, দাবি পুলিশের। অভিজিৎ আর টিঙ্কু পরস্পরের পরিচিত। তাদের মাধ্যমেই বিহারের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে পরিচয় হয় রোহনের। তবে অভিজিৎ এবং টিঙ্কুর সঙ্গে রোহন এবং অমিতের যোগাযোগ কী ভাবে হল, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি বলে দাবিপুলিশ সূত্রের।
যদিও স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের একাংশের বক্তব্য, ইংরেজবাজারের ঝলঝলিয়ায় যথেষ্ট ‘দাপট’ ছিল দুলাল সরকার এবং তাঁর এক সময়ের বন্ধু, তৃণমূলের শহর সভাপতি নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারির। ২০২২ সালে পুরভোটের পর থেকে দুই বন্ধুর সম্পর্কে ‘ফাটল’ ধরে। নরেন্দ্রনাথের উপরে হামলায় নাম জড়ায় দুলালের অনুগামীদের। তবে এলাকায় তাঁদের প্রভাব কমেনি। তেমন এলাকায় অমিত-রোহনের মতো দুই যুবক কী ভাবে ‘গ্যাং’ গড়ে দুলালকে খুন করার পরিকল্পনা করল, উঠছে সেই প্রশ্নও।
বাড়ি গিয়ে, ফোন করে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। জবাব মেলেনি মোবাইল-বার্তার। তবে নিহত তৃণমূল নেতার স্ত্রী তথা ইংরেজবাজারের পুরপ্রতিনিধি চৈতালী ঘোষ সরকার বলেন, ‘‘জমি সংক্রান্ত বিষয়ে এই খুন, মানতে পারছি না। বড় ষড়যন্ত্র রয়েছে। বড় কোনও মাথা রয়েছে। আশা করছি, পুলিশ তাদের খুঁজে বার করবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমার স্বামীকে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হল। আমি এবং আমার ছেলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’’ তৃণমূলের চাঁচলের বিধায়ক তথা ইংরেজবাজারের প্রাক্তন পুরপ্রধান নীহাররঞ্জন ঘোষ বলেন, ‘‘পুলিশের আরও খুঁটিয়ে তদন্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। তবেই প্রকৃত অপরাধীরা সামনে আসবে।’’ নদিয়ার ফুলিয়ায় রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, ‘‘তদন্তটা কোর্ট মনিটরিংয়ে সিবিআই-এর হাতে যাক, আমি এটা দাবি করব।’’