স্ত্রীর পাশে অসহায় তাহের শাহ। — নিজস্ব চিত্র।
ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন ২০১৫ সালে। তখন পাকাপাকি ভাবে বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় ছিটমহল থেকে মূল ভূখণ্ডে চলে এসেছিলেন আবু তাহেররা। প্রায় ১০ বছর পার হতে চললেও ভারতীয় নাগরিক হওয়ার ‘স্বীকৃতি’ পাননি তাঁরা। তাহেরের অভিযোগ, দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে তাঁকে এবং তাঁর মতো আরও অনেককে। কাজকর্ম ছেড়ে আবার ফিরে আসতে হয়েছে দিনহাটার সেই সেটলমেন্ট ক্যাম্পে। দীর্ঘ দিন ধরে ছিটমহলের মানুষজনের জন্য আন্দোলন করা সমাজকর্মীর দাবি, শুধু রাজ্য নয়, কেন্দ্রীয় সরকারেরও এই মানুষজনের কথা ভাবা উচিত। তবেই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে এ দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের কিছু বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে কোচবিহার জেলাতেই রয়েছেন ৯২১ জন। ২০১৫ সালে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পর থেকে তাঁরা এ দেশেই বসবাস করছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগেরই রোজগারের একমাত্র পথ পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করা। দিল্লি বা ভিন্রাজ্যে গিয়ে মূলত শ্রমিকের কাজ করেন তাঁরা। দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে সেখানকার পুলিশের কাছে হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করলেন ছিটমহল বিনিময়ের সময় ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়া তাহের।
২০১৫ সালের আগে তাহের বাংলাদেশের ছোট গারালঝোরা ২ নম্বর ছিটমহলে থাকতেন। ওই বছর দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির পর ভারতীয় নাগরিকত্ব পান তিনি। সেই থেকে দিনহাটা সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে বাস তাহেরের। তাহেরের সঙ্গেই এ দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং কন্যা। যদিও ছোট গারালঝড়া ২ নং ছিটে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবেই থেকে যান তাঁর বাবা-মা। ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তাহের ভারত সরকারের দেওয়া ছিটমহল বাসিন্দাদের জন্য বিশেষ পরিচয়পত্র, ট্রাভেল পাস-সহ কিছু নথি পেয়েছিলেন। ক্রমে তিনি নিজের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড-সহ অন্যান্য পরিচয়পত্রও তৈরি করিয়েছেন।
অভিযোগ, এই সব পরিচয়পত্র, বৈধ নথি থাকা সত্ত্বেও দিল্লিতে কাজ করতে গিয়ে সেখানকার পুলিশের কাছে হেনস্থার শিকার হয়ে হয়েছেন তাহের। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দিনহাটার সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে ফিরে এসেছেন তিনি। তাহেরের দাবি, সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ দিল্লিতে থাকছেন এমন বাঙালিদের কাছ থেকে তাঁদের বৈধ পরিচয়পত্র দেখতে চায়। তাহের তাঁর আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ট্রাভেল পাস দেখান। তার পরেও দিল্লি পুলিশ তাঁর বাবা-মায়ের আধার কার্ড দেখতে চায় বলে দাবি তাহেরের। প্রসঙ্গত, তাহের ২০১৫ সালে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও তাঁর বাবা-মা তা করেননি। তাঁরা বাংলাদেশে নাগরিক হয়ে থেকে গিয়েছেন। সে কারণে বাবা-মায়ের আধার কার্ড দেখাতে পারেননি তাহের। তাঁর অভিযোগ, দিল্লি পুলিশ তা মানতে চায়নি। তারা বার বার তাঁর বাবা-মায়ের আধার কার্ড দেখতে চেয়েছে।
তাহেরের আরও দাবি, তাঁর মতো যাঁরা ছিটমহল বিনিময়ের সময় এ দেশে এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই বাবা-মায়ের আধার কার্ড দেখাতে না পারায় দিল্লি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। আর সে জন্যই ভয়ে পরিবার নিয়ে আবার দিনহাটায় ফিরে এসেছেন তিনি। তাহেরের মতো সমস্যায় পড়েছেন দিনহাটা সেটেলমেন্ট ক্যাম্পের আর এক বাসিন্দা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, ছিটমহল বিনিময়ের আগে তাঁর বাড়ি ছিল বাংলাদেশের দাসিয়ার ছড়া এলাকায়। ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময়ের পর তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে দিনহাটার এই সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে রয়েছেন। তাঁর দাবি, দিল্লিতে গিয়ে তিনিও পুলিশি হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন।
ছিটমহল আন্দোলনের প্রথম সারির মুখ সমাজকর্মী দীপ্তিমান সেনগুপ্ত মনে করেন, কেন্দ্র-রাজ্য ‘দ্বৈরথ’ না করে দুই সরকারেরই উচিত এই মানুষগুলির দিকে নজর দেওয়া। এই আন্দোলনের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন দীপ্তিমান। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৫ সালে যে ৯২১ জন বাংলাদেশি ছিটমহল বিনিময়ের ফলে ভারতের নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন, তাঁদের ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা উচিত কোচবিহার জেলা প্রশাসনের। যাতে তাঁরা দেশের যে কোনও প্রান্তে গিয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন।’’ পাশাপাশি, ছিটমহলের বাসিন্দাদের জমির কাগজ-সহ একাধিক বিষয় নিয়েও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন দীপ্তিমান।