প্রতীকী ছবি।
মাঠে খেলোয়াড়েরা কতটা নিরাপদ? ফুটবলার দেবজ্যোতি ঘোষের মৃত্যুর পর সেই প্রশ্নই নানা ভাবে সামনে আসতে শুরু করেছে। প্রশ্ন তুলছে খোদ দেবজ্যোতির পরিবার। তাঁর বাবাই প্রথম বলেছিলেন, “মাঠে একটা অ্যাম্বুল্যান্স থাকলে আমার ছেলেকে এ ভাবে চলে যেতে হত না।” দেবজ্যোতিই যে প্রথম তা নয়। এর আগেও ফুটবল-ক্রিকেট মাঠে অসুস্থ বা আহত হয়ে খেলোয়াড়ের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তা থেকে কোনও টুর্নামেন্টের আয়োজকই শিক্ষা নেয়নি।
অভাবের সঙ্গে কঠিন লড়াই করে নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করছিলেন কৃষ্ণনগরে শুকুল রোডের বাসিন্দা দেবজ্যোতি। কলকাতা ময়দান, কালীঘাট, টালিগঞ্জ, রেলওয়ে এফসি। স্বপ্ন ছিল, ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরে মাঠে নামার। সেই স্বপ্নটাকে ছুঁয়েই তাঁকে চিরতরে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হল। বেলপুকুরে টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে মাঠেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে আনার আগেই মৃত্যু হয় তাঁর।
এই ঘটনার পরই দেবজ্যোতির বাবা দুলালচন্দ্র ঘোষ প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন সে দিন মাঠে অ্যাম্বুল্যান্স ছিল না, কেন কোনও চিকিৎসক ছিল না? তিনি দাবি করেন, যদি মাঠে এই সমস্ত ব্যবস্থা থাকত তা হলে দেবজ্যোতিকে মরতে হত না।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে মাঠে খেলোয়াড়দের ন্যূনতম নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে না সেটা স্বীকার করে নিচ্ছেন নদিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আয়োজকরা। কৃষ্ণনগর শহর ঘেঁষা ভাতজাংলার মিলন মন্দির ক্লাব সারা বছর ধরে পুরুষ ও মহিলাদের ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবলের টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। তাদের মাঠেও অ্যাম্বুল্যান্স থাকে না। থাকে না কোনও মেডিক্যাল টিম। যদিও ক্লাব কর্তৃপক্ষের দাবি, পাশেই গ্রাম পঞ্চায়েতের অ্যাম্বুল্যান্স আছে। এ ছাড়া মাঠের পাশেই এক জন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের চেম্বার আছে। এই ব্যবস্থা কি যথেষ্ট? ক্লাবের সম্পাদক আশিস রাউতের বক্তব্য, “গ্রাম ও মফস্সল এলাকায় এত টাকা দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব নয়। চিকিৎসকের প্রয়োজন হলে এক জন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসককে সব সময় হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছি। আমাদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
শীত শেষে বাতাসের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। ঝাঁ ঝাঁ রোদের ভিতরেও ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়। গরমের মধ্যে খেলোয়াড়দের অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নানা মাঠে খেলতে নেমে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে থাকে।
কালীগঞ্জের পাঁচখেলা যুব সঙ্ঘের কর্তাদের দাবি, তাঁরা মাঠের পাশে অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড় করিয়ে রাখেন। সেই সঙ্গে এক জন গ্রামীণ চিকিৎসককে রেখে দেওয়া হয়। ক্লাবের সম্পাদক জহিরুদ্দিন শেখ বলছেন, “এত টাকা খরচ করে প্রতি দিন অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে রাখার ক্ষমতা আমাদেরও নেই। এক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যবস্থা করে দেন।”
সকলেরই এমন শুভাকাঙ্ক্ষী থাকে না। তাদের পক্ষে টুর্নামেন্টের খরচ সামলে অ্যাম্বুল্যান্স, চিকিৎসক তৈরি রাখা সম্ভব হয় না। যেমনটা সম্ভব হয়নি বেলপুকুর-পোলতা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষেও, যাদের আয়োজিত টুর্নামেন্টে খেলতে নেমে মাঠের ভিতরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন দেবজ্যোতি। সেই সংগঠনের অন্যতম কর্তা গৌতম ঘোষ বলছেন, “আমরা গ্রামের মাঠে টুর্নামেন্টের আয়োজন করি। এখানে খেলা পরিচালনা করার খরচ জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানে অ্যাম্বুল্যান্স, চিকিৎসকের জন্য খরচ করা সত্যিই অসম্ভব।” তাঁর কথায়, “তবে এ বার যা ঘটল তাতে আর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আমরা চেষ্টা করব অন্তত একটা অ্যাম্বুল্যান্স ও অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার।”
করিমপুর জোনাল স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান সুজিত বিশ্বাস বলছেন, “উচিত তো অনেক কিছুই। কিন্তু চাইলেও সবটা করা সম্ভব হয় না। এত টাকা কোথায়? গ্রাম বাংলার ছেলেমেয়েরা এভাবেই খেলতে অভ্যস্ত।” তাঁর মতে, “এত কিছুর আয়োজন করতে হলে টুর্নামেন্টই বন্ধ করে দিতে হবে। তা হলে নতুন খেলোয়াড় তুলে আনা সম্ভব হবে না।” তা হলে কি এমন ভাবেই চলতে থাকবে? খেলার মাঠে অকালে ঝরে যাবে দেবজ্যোতিরা?
নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক গৌতম বিশ্বাস বলছেন, “জেলা স্টেডিয়ামে খেলা হলে আমরা সব ব্যবস্থাঈই রাখি। কিন্তু সর্বত্র সেটা সম্ভব হয় না। অর্থের সঙ্কট তো আছেই, সারা দিনের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়াই কঠিন।” তাঁর আশ্বাস, “মাঠে খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। মাঠের বাইরে অন্তত একটা গাড়ি ও অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার চেষ্টা করা হবে ।”