Dolyatra

খেলাটা হল নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার

ভুল ভাবলাম। একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না তিনি, কেবল বাঁ গালে সজোরে একটি, একটিই, চড় কষিয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন।

Advertisement
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৩ ০৫:৩৯

অঙ্কন: কুণাল বর্মণ

যদি বলি একটি চপেটাঘাতে আমার দোলখেলা জন্মের মতো ঘুচে গিয়েছিল, তা হলে রথের চাকা মাটিতে নেমে আসবে, কেননা তার পরেও কিছু কাল আবির খেলেছিলাম। কিন্তু এটা একেবারে ষোলো আনা সত্য যে জীবনে ওই এক বারই চড় খেয়েছি। যত দূর মনে পড়ে, তখন ক্লাস ফাইভ। সক্কাল সক্কাল যথারীতি টিনের ভাঙা বালতিটাতে রং গুলে প্লাস্টিকের পিচকিরি হাতে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার দোল মানে ছিল বাড়িতে বড়দের পায়ে আবির দিয়ে মুখমণ্ডলে রিটার্ন গিফ্ট নিয়ে পথে নামা এবং পাড়ার চেনা লোক হেঁটে গেলে পিচকিরি তাক করা। অবশ্যই নিয়ম করে জানিয়ে দেওয়া হত বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ফরসা জামাকাপড় দেখলে রং দিবি না, আর অচেনা কাউকে যেন, খবরদার... মেনেই চলতাম সে-কথা।

কিন্তু সে-দিন হল কি, অনেক ক্ষণ ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, চেনা লোকেরা সব যেন বেবাক উধাও হয়ে গিয়েছে, বালতি তো দূরের কথা, পিচকিরিও খালি হয় না। যত ভিতুই হোক, ক্লাস ফাইভের ধৈর্যেরও তো সীমা আছে, সামনে এক বয়স্ক মানুষকে টুকটুক করে হেঁটে যেতে দেখে যা থাকে কপালে বলে পিচকিরি তাক করে দিলাম তার পেটটা টিপে। সাধারণত প্যারাবোলার দৌড় বিঘতখানেকের বেশি হত না, কিন্তু— কী ছিল বিধাতার মনে— সেই বসন্তদিনে একেবারে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ ঘটে গেল।

Advertisement

ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন, তার পর ঘুরে দাঁড়িয়ে খুব ঠান্ডা চোখে তাকালেন, ডান হাতের তর্জনীটা দু’বার উঠল এবং নামল, মন্ত্রমুগ্ধের মতো গুটিগুটি এগিয়ে গেলাম, ভাবলাম খুব বকুনি খাব। ভুল ভাবলাম। একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না তিনি, কেবল বাঁ গালে সজোরে একটি, একটিই, চড় কষিয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন। সত্যজিৎ তখনও গুপী-বাঘার জন্ম দেননি, তা না হলে নিশ্চয়ই মনে মনে বলতাম ‘কী দাপট!’ অবশ্য কিছুই বলার মতো অবস্থা ছিল না, দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম, কান্না থামতে অনেকখানি সময় লেগেছিল। বালতিটা পরে কে তুলে এনেছিল জানিও না।

অঙ্কন: কুণাল বর্মণ

পিচকিরির সঙ্গে সম্পর্ক সেই শেষ। নিজেরই আর ইচ্ছে হয়নি; ব্যথা ভুলতে সময় লাগে না, কিন্তু অপমানের বোধটা বেশ টেকসই ছিল বোধহয়। আবির দিয়ে অমৃতের স্বাদ মেটানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু দু’এক বছরের মধ্যে আবিষ্কার করলাম, শুকনো পাউডারে তেমন সুবিধে হচ্ছে না। জানি, সেটা সুরুচির পরিচয় নয়; কোথায় রাঙা ধুলোয় আকাশ রঙিন করে দেওয়ার পরিশীলিত (অনুমোদিত উচ্চারণ: ‘পরিষীলিত’) সংস্কৃতি আর কোথায় পিচকিরি থেকে নানা রঙের— জলবাদীরা মাপ করবেন— পানি প্রক্ষেপণের প্রাকৃত উল্লাস! কিন্তু সত্য সে যে সুকঠিন! বস্তুত, বয়েস বাড়লে এমন পিচকিরি-প্রীতির একটা জুতসই যুক্তিও খুঁজে নিয়েছি: আসলে ওটা তীরন্দাজের তৃপ্তিযোগ, কিংবা অনেক উঁচু আকাশ থেকে বোমা ছুড়ে গোটা গোটা শহর, গ্রাম, মায় দেশ অবধি ধ্বংস করে দেওয়ার পরম সার্থকতা। এমন ভূমানন্দের পাশে আবির মাখানোর আদিখ্যেতা? আরে রাম রাম রাম!

অতএব, কী আর করা! স্কুল ছাড়ার অনেক আগেই দোলখেলা ছেড়ে দিলাম। অনেক দিন অবধি তাতে কোনও সমস্যা হয়নি, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও বিশেষ কারও বহুরূপী সাজবার আকুলতা ছিল না, বরং এই দিনটা লোভনীয় ছিল নিশ্ছিদ্র আড্ডার জন্যই। কিন্তু একটা সময়ের পরে লক্ষ করলাম, দোল কখন হোলি হয়ে গিয়েছে, এবং চার পাশে ‘আজ হোলির রঙে রং মেশাতে হবে’ বলে একটা সামাজিক চাপ তৈরি হচ্ছে। সেটা নিছক রং মাখার চাপ নয়। বস্তুত, রাস্তাঘাটে রঙের আক্রমণ, অন্তত শহরের মধ্যে, অনেক দিনই প্রশমিত হয়েছে। এখন আর বালতি হাতে পিচকিরি নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে বলে মনে হয় না, আবার পিছন থেকে এসে অতর্কিতে সারা মুখে বিজাতীয় রং বা আরও বিজাতীয় তরল পালিশ করে দেওয়ার উল্লাসও পরিচিত পরিসরে আর দেখি না, বরং স্বাস্থ্যসচেতন নাগরিকরা ভেষজ আবিরের ভক্ত হয়েছেন, আসল হোক নকল হোক হার্বাল রঙের বাজার দ্রুত বাড়ছে। মধ্যবিত্ত জীবনে হোলি এখন রীতিমতো ‘হাই কালচার’।

কিন্তু সেই কালচার উদ্‌যাপনের দাপটও দেখতে দেখতে বেড়ে উঠল। দিকে দিকে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে যে, এই দিনটিতে শুকনো রং খেলা সেরে তরলিত চন্দ্রিকায় রঙিন হয়ে ‘রঙ্গ্ বরসে’ নামক অবিনশ্বর সঙ্গীতের সুরবিহীন হেঁড়ে গলায় গলা মিলিয়ে নাচতে হবে, নাচতে না জানলে এবং দ্রব্যগুণের মহিমায় ডান্স-ফ্লোর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁকা হলে বসে বসেই কোমর দোলাতে হবে, নচেৎ আপনি নিতান্তই বেরসিক।

ও হ্যাঁ, আসল কথাটাই তো ভুলে যাচ্ছিলাম। প্রথমত রঙে রঙে রঙিন হয়ে একক এবং যৌথ ছবির পসরা আপলোড করতে হবে, দ্বিতীয়ত ওই— রঙ্গ্ বরসে সহ— আনন্দ উদ্‌যাপনের চলৎচিত্র ক্রমাগত সমাজমাধ্যমে দিয়ে যেতে হবে, ছোট ছোট ক্লিপ করে দেওয়া দরকার, তা না হলে কেউ দেখবে না, সাতান্ন সেকেন্ডের বেশি মনঃসংযোগ করা বেজায় কঠিন।

এ-সব পোষায় না? একঘেয়ে লাগে? চিন্তার কোনও কারণ নেই। খেলাটা এক বার ধরে ফেলতে পারলে খুব অল্প পরিশ্রমেও হোলির ধামাকা ‘মানাতে’ পারবেন। আসলে খেলাটা হল নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার। অবশ্যই জানবেন, এই উৎসবের আসরে কোথাও কখনও নায়কনায়িকার অভাব হয় না, সুতরাং চাইলেই আপনি এক্সট্রার ভূমিকায় দিব্যি নিজেকে ফিট করিয়ে নিতে পারেন। কেবল মাঝে মাঝেই মুখে এক পশলা হাসি এনে কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখতে হবে, আর ডজনে আঠারোটা রসিকতা শুনতে শুনতে থেকে থেকেই ঝোপ বুঝে ‘এটা একঘর হয়েছে’ কিংবা ‘নাজ়ুক’ অথবা ও-রকম কিছু বলতে পারলে তো কথাই নেই! আর হ্যাঁ, কোমর দুলুক বা না দুলুক, সক্কাল সক্কাল রঙ্গ্ বরসেটা প্র্যাক্টিস করে নেওয়া দরকার।

আরও পড়ুন
Advertisement