আবেগের বেলাগাম সড়কে
Jagaddhatri Puja

Jagddhatri Puja 2021: ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে উচ্ছৃঙ্খলা ?

সন্ধ্যায় পুরসভা মোড়ে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রাত গড়াতেই বেলাগাম হল। মারধর করা হল এক সংবাদকর্মীকে, তিনি ছুটে থানায় ঢুকে প্রাণ বাঁচালেন।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২১ ০৭:৩২
সাঙে জগদ্ধাত্রী বিসর্জনের দাবিতে কোতোয়ালি থানা ঘেরাও। মঙ্গলবার রাতে কৃষ্ণনগরে।

সাঙে জগদ্ধাত্রী বিসর্জনের দাবিতে কোতোয়ালি থানা ঘেরাও। মঙ্গলবার রাতে কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

আদালতের নির্দেশ যা-ই থাক, সাঙে জগদ্ধাত্রী বিসর্জনের দাবি জোরদার হচ্ছিল গত কয়েক দিন ধরেই। কৃষ্ণনাগরিকদের বড় অংশের ‘আবেগ’ যে জড়িত, তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রশাসনের কাছে। কিন্তু সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ যে এমন একটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছবে, তা বোধহয় কেউ কল্পনাও করতে পারেননি।

তার ফল, সন্ধ্যায় পুরসভা মোড়ে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রাত গড়াতেই বেলাগাম হল। মারধর করা হল এক সংবাদকর্মীকে, তিনি ছুটে থানায় ঢুকে প্রাণ বাঁচালেন। কিন্তু প্রাণ বাঁচল না সেই বালকের, জাতীয় সড়কে দীর্ঘক্ষণ অবরোধে আটকে ছিল যার অ্যাম্বুল্যান্স।

Advertisement

মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত গড়ানো বিক্ষোভ-অবরোধের শেষে পুলিশ জাতীয় সড়ক থেকে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া ও জাতীয় সড়ক অবরোধের মামলা রুজু করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। পুলিশ জানায়, ধৃতেরা হল কৃষ্ণনগরের কলেজ স্ট্রিট এলাকার বাসিন্দা রানা সিংহ ও শ্রীতম পালচৌধুরী, নগেন্দ্রনগরের সঞ্জীব হালদার, ঘূর্ণী আজাদ হিন্দ সরণীর সানি ভট্টাচার্য ও কৃষ্ণগঞ্জের খালবোয়ালিয়ার রঞ্জিত সর্দার। এর মধ্যে সানির বাবা ত্রিদীপ ভট্টাচার্য বর্তমানে পুলিশ লাইনে এএসআই পদে রয়েছেন। বুধবার কৃষ্ণনগর আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক তাদের ১৪ দিন জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও ধৃতদের পরিবারের দাবি, তারা কেউই অবরোধে ছিল না। হোটেল থেকে খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে।

কোভিড পরিস্থিতির কারণে হাই কোর্টের নির্দেশে গত বছর থেকেই বিসর্জনের সময়ে বেহারাদের কাঁধে বাঁশের মাচায় প্রতিমা বহন বা সাং ব্যবহারের উপরে স্থগিতাদেশ জারি করেছে প্রশাসন। তার বিরুদ্ধে মামলা করেও হেরে গিয়েছে কৃষ্ণনগরের বেশ কয়েকটি বারোয়ারি। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি বহাল থাকা সত্ত্বেও এ বার কৃষ্ণনগরের কিছু বাসিন্দা ও পুজো কমিটির কর্মকর্তারা গোঁ ধরেন, সাঙের অনুমতি দিতেই হবে, শহরের ‘ঐতিহ্য’ তাঁরা নষ্ট হতে দেবেন না।

পুলিশ সূত্রের খবর, সাঙের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করেন কয়েক জন মহিলা। সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেই গ্রুপে পরে পুরুষদেরও যুক্ত করা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, সাঙের দাবিতে আন্দোলন হবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় পুরসভা মোড়ে জমায়েতের ডাক দেওয়া তার আগে থেকেই লোকজন জড়ো হতে শুরু করে। কমবয়সিরাই সংখ্যায় বেশি। হাজার খানেক মানুষের জমায়েতে পথ অবরুদ্ধ হয়। কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গেই ভিড় পাতলা হতে থাকে। কিন্তু পুলিশ এসে বুঝিয়ে রাস্তা ফাঁকা করতে গেলে অবরোধকারীরা জানিয়ে দেন, সাঙের অনুমতি না মেলা পর্যন্ত অবরোধ চলবে।

রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ অবশ্য অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। সমবেত জনতা পাশেই কোতোয়ালি থানার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। ঘেরাও করা হয় থানা। কোতোয়ালি থানার আইসি রক্তিম চট্টোপাধ্যায় অনেক বুঝিয়েও তাদের নিরস্ত করতে পারেননি। উল্টৈ সেখান থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের দিকে চলে যায় ভিড়। যাওয়ার পথে তৃণমূলের ফ্লেক্স ছিঁড়ে, গেট ভেঙে তাণ্ডব চালায় কিছু যুবক। সেই ছবি করতে গিয়ে আক্রান্ত হন সংবাদমাধ্যমের এক কর্মী। কোনও মতে হামলাকারীদের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে থানায় ঢুকে তিনি রক্ষা পান। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের লক্ষ্য করে হুমকি দেওয়াও শুরু হয়ে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে গালিগালাজ।

রাত সওয়া ১১টা নাগাদ ভিড়টা পিডব্লিউডি মোড়ে পৌঁছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে। একের পর এক টায়ার পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখানো হতে থাকে। পুলিশ ছিল কার্যত দর্শক। তাদের টনক নড়ে ভিড়ে আটকে থাকা অ্যাম্বুল্যান্সে বালকের মৃত্যুর খবর আসার পরে।

পুলিশ লাঠি হাতে তেড়ে গেলে রণে ভঙ্গ দেয় অবরোধকারীরা। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে পাঁচ যুবক। তাদের পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে আসে, সঙ্গে ১০টি মোটরবাইক। পরে মৃত বালকের বাবা লিখিত ভাবে অভিযোগ করলে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। নিজে থেকেও মামলা রুজু করে পুলিশ।

অনেকেরই মনে পড়ছে, এর আগে জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিজেপির পথসভার ভিড়ে আটকে গিয়েছিল এমনই একটি অ্যাম্বুল্যান্স, যাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল প্রসূতিকে। সেই অ্যাম্বুল্যান্সকে রাস্তা করে তো দেওয়াই হয়নি, উল্টে সভামঞ্চ থেকে বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ মাইকে বলেছিলেন, অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এটাই কি তা হলে কৃষ্ণনগরের ‘ঐতিহ্য’ হয়ে দাঁড়াল? এত দিন যাঁরা সাঙের দাবিতে আন্দোলনের পক্ষে গলা ফাটিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এখন বলেছেন, এই অমানবিকতা বা উচ্ছৃঙ্খলতা কোনও শহরের ‘ঐতিহ্য’ হতে পারে না। বরং তাঁদের সন্দেহ, ‘অন্য কোনও শক্তি’ এর পিছনে ইন্ধন জুগিয়েছে। উৎসবের আগে শহর অশান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠছে, দীর্ঘক্ষণ পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়’ ভূমিকা পালন করা নিয়েও। যদিও পুলিশের দাবি, উৎসবের আগে তারা বলপ্রয়োগ রপকে চায়নি। বরং আলাপ-আলোচনার পথেই বিক্ষোভ সামলানোর চেষ্টা করেছে।

আরও পড়ুন
Advertisement