আষাঢ় ফুরিয়ে গেল। অথচ, পাতে পড়ল না ইলিশ। রীতিমতো আক্ষেপের সুরে বলছিলেন গৃহকর্ত্রী মা। “এর পর দুর্গাপুজো এসে গেলে দশমীর পর থেকে এমনিই ইলিশ খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।”
মায়ের সেই হা-হুতাশ শুনে সাতসকালে এ বার-ও বাজার ঘুরে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত নবদ্বীপ বড়বাজার থেকে ইলিশ কিনেছেন শ্যামসুন্দর ভুঁইয়া। ওজন ৩২০ গ্রাম। দাম ৬০০ টাকা কেজি। সাকিন দিঘা।
ইলিশ বিনা বর্ষাকাল বিফলে যায় বুঝি। বর্ষা অথচ ইলিশ নেই— এটা মেনে নিতে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরের মানুষের। কিন্তু মাছের আড়তদার, পাইকার থেকে খুচরো বিক্রেতা কেউই ভরসা দিতে পারছেন না শ্রাবণেও তার দেখা মিলবে কিনা। এই রাজ্যের দিঘা বা ডায়মন্ডহারবারে যেমন মিলছে না ইলিশ, তেমনই বাংলাদেশের ইলিশেরও তেমন জোগান নেই। মাছের বাজার আলো করা রুপোলি শস্যের দল এ বার অনুপস্থিত।
কিন্তু কেন? জবাব ইলিশের মতোই অধরা মৎস্য-বিশেষজ্ঞদের কাছেও। সিঙ্গুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান এবং মৎস্য গবেষক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী বলেন, “ইলিশের মতিগতি এখনও বিজ্ঞান বুঝে উঠতে পারেনি। দূষণ বা অন্য যে সব কারণকে ইলিশ না আসার জন্য দায়ী করা হয়, গত দু’ বছর ধরে অতিমারির জন্য সেই তা আর প্রকট নয়। জলে দূষণ বা যান চলাচল অনেক কম। ফলে, এই বছর ইলিশ বেশি আসার কথা ছিল। কিন্তু ইলিশের এমন দুরাবস্থা বহু দিন দেখা যায়নি।”
একই কথা বলছেন ছোট-বড় ব্যবসায়ীরাও। নদিয়ার পাইকারি মৎস্য ব্যবসায়ী চিন্ময় ভৌমিক বলেন, “এই বছর কোথাও ইলিশ নেই। দিঘায় সামান্য কিছু ইলিশ উঠছে। খুবই ছোট চারশো গ্রামের মধ্যে ওজনের। বাংলাদেশের ইলিশের জোগান নেই বললেই চলে। বাজারে সামান্য যা ইলিশ দেখা যাচ্ছে সে সবই স্টোরের মাছ। তার মধ্যে মায়নমারের ইলিশই বেশি। স্বাদ তেমন নয়। লোকে তা-ই ৮০০-৯০০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।”
অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী চিন্ময়বাবুর অভিমত, এই মরসুমে আর সম্ভবত তেমন ইলিশ পাওয়া যাবে না।
তাঁর কথার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল কৃষ্ণনগরের মৎস্য ব্যবসায়ী শতদল হালদারের বক্তব্য। তিনি বলেন, “কেন পাওয়া গেল না, তা বলতে পারব না। তবে যা মনে হচ্ছে এবারটা এই ভাবেই যাবে। এই মরসুমে আর সেভাবে ইলিশ বাজারে আসবে না। সে লক্ষণ জষ্টি মাস থেকে বোঝা যায়। আমরা যা বিক্রি করছি সবই গত বছরের মজুত মাছ। সে মাছও ফুরিয়ে আসার সময় হল। মাঝে মধ্যে অল্প কিছু দিঘার মাছ আসছে। ডায়মন্ডহারবারে ইলিশের নামগন্ধ নেই।”
সৈয়দ মুজতবা সিরাজ লিখেছেন, মুহম্মদ-বিন তুঘলকের মৃত্যুর জন্য নাকি দায়ী ছিল ইলিশ মাছ!
মুজতবা আলি কাহিনির শেষে মন্তব্য করেছিলেন— “সেই অচেনা মাছটি ইলিশই ছিল। এবং ইলিশ খেয়ে যখন সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে, তখন নিশ্চিত তিনি বেহস্তে গেছেন।”
সেই ইলিশই এ বার নাস্তি! এমন ইলিশহীন বর্ষা শেষ কবে দেখেছেন মনে করতে পারছেন না অতিবড় ইলিশ ভক্তও। ‘পহিল ভাদরে’ তাঁর আশায় যতই বুক বাঁধুক ইলিশভক্তের দল, নবদ্বীপের মাছ বিক্রেতা বাদল হালদার এক ফুঁয়ে সে আশা নিভিয়ে দিয়েছেন।
‘‘বর্ষাই নেই তো ইলিশ আসবে কোথা থেকে? এই প্রবল রোদ আর ভ্যাপসা গরমে ইলিশ ওঠে নাকি? মেঘলা আকাশ। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া, তবে ইলিশ পাওয়া যেতে পারে। এবারের মতো শেষ। যদি শীতের মরসুমে কিছু পাওয়া যায়।” বলছেন তিনি।
অতএব, এখন শুধুই অপেক্ষা।