রাত থেকে লাইন দিয়েও টিকা মেলেনি। বিক্ষোভ কৃষ্ণনগর পুরসভার টিকাকেন্দ্রে। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র।
করোনা টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ বেশ কিছু দিন ধরেই উঠছে। শুক্রবার কৃষ্ণনগর পুরসভার টিকাদান কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রাক্তন পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখালেন শহরের সাধারণ মানুষ।
মঙ্গলবার মাঝরাত থেকে টিকার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই সব নাগরিকদের অভিযোগ, প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা বর্তমান পুরবোর্ডের অন্যতম প্রশাসক অসীম সাহার ‘সুপারিশ’ থাকা লোকেদের টিকা দিয়ে বাকিদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। বিষয়টি জানাজানি হতেই তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখানো হয়। হাসপাতালের গেটের দুটো তালাও ভেঙে ফেলে উত্তেজিত জনতা। কোতোয়ালি থানার পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বিরোধীদের অভিযোগ, প্রাক্তন পুরপ্রধান তাঁর ঘনিষ্ঠ ও অনুগতদের জন্য টিকার ‘সুপারিশ’ করছেন। যদিও অর্থের বিনিময়ে টোকেন দেওয়ার অভিযোগে পুরসভার পক্ষ থেকে দু’জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
কৃষ্ণনগরের চৌধুরীপাড়া এলাকায় পুরসভার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রথম থেকেই টিকা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে টিকার অভাবে সেখান থেকে শুধু দ্বিতীয় ডোজ় দেওয়া হচ্ছে বলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীরা জানিয়েছেন। অন্য দিনের মতো শুক্রবারও মাঝরাত থেকে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বহু মানুষ। তাঁদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি। লাইনে থাকা লোকজনের অভিযোগ, দুপুর ২টো নাগাদ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যাঁদের কাছে প্রাক্তন পুরপ্রধানের সই করা আধার কার্ডের প্রতিলিপি নেই তাঁদের আর টিকা দেওয়া হবে না। তাঁদের আবার পরের দিন আসতে হবে।
এর পরেই খেপে যান লাইনে থাকা লোকজন। শুরু হয়ে যায় চিৎকার চেঁচামেচি। কর্মীদের ঘিরে বিক্ষোভ শুরু হতেই হাসপাতালের গেটে তালা দিয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা সেই তালা ভেঙে ফেলেন। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকায় পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
এ দিন ভোর ৪টে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা না পেয়ে ফিরতে হয়েছে বছর পঁয়ষট্টির কল্পনা প্রামাণিককে। তিনি বলেন, “এতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে! আর চোখের সামনে অসীম সাহার সই করা কাগজ নিয়ে এসে কিছু লোকজন লাইনে না দাঁড়িয়ে টিকা নিয়ে গটগট করে চলে যাচ্ছে।” প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের যাত্রাপুর থেকে আসা বছর সত্তরের সুবোধ পোদ্দারের আক্ষেপ, “আগের দিন বিকেলে এসে টোকেন নিয়ে গিয়েছিলাম। তার পর ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে। দুপুর ২টো নাগাদ জানতে পারি, আমাদের আর টিকা দেওয়া হবে না। অসীম সাহার সই করা কাগজ যাদের আছে, তাদেরই কেবল টিকা দেওয়া হবে।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই অসীম সাহার সই করা কাগজ দেখিয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে টিকা নিয়ে চলে যাচ্ছে প্রচুর লোক। প্রতি দিন এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য যে পরিমাণ টিকা বরাদ্দ করা হয় তার একটা বড় অংশ দেওয়া হয় এই সই করা কাগজ যারা নিয়ে আসে তাদের। এ দিন ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুরকর্মী রাহুল সাহা বলেন, “আজ আমাদের কাছে আড়াইশো জনের জন্য টিকা ছিল। ২২৪ জনকে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে অসীমবাবুর পাঠানো ৬৫ জনকে দেওয়া হয়েছে। প্রতি দিনই আমরা অসীমবাবুর পাঠানো লোকেদের টিকা দিই। এটা তাঁর নির্দেশ।”
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের অভিযোগ, তাঁদের বাড়ি পাঠিয়ে বাকি ২৬টি টিকাই অসীম সাহার পাঠানো লোকেদের দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিক্ষোভের জেরে সেটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য স্বাস্থ্যকর্মীরা।
বিজেপির নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলার মিডিয়া আহ্বায়ক সন্দীপ মজুমদারের অভিযোগ, “তৃণমূলের নেতারা সর্বত্র টিকা নিয়ে স্বজনপোষণ করছেন। এখানে অসীমবাবুর অনুগত লোকেদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পুরভোটের আগে টিকা পাইয়ে দিয়ে অনুগত করার চেষ্টাও হচ্ছে। আর মাঝখান দিয়ে অসহায় সাধারণ মানুষজন বঞ্চিত হচ্ছেন।”
তবে অসীম সাহার দাবি, “পুরসভার কর্মী ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কারণ তাঁরাও এই অতিমারির মধ্যেও মানুষকে পরিষেবা দিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেই কারণে প্রতিদিন তিন ভাগের এক ভাগ টিকা আমরা এঁদের দিচ্ছি। বাকি লাইনে দাঁড়ানো লোকেদের দেওয়া হচ্ছে।” যদিও ভুক্তভোগীদের দাবি, যাঁরা সই করা কাগজ নিয়ে আসছেন তাঁদের অনেকেই পুরকর্মী ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কেউ নন। পুরসভা ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মোট কত কর্মী আছেন এবং তাঁদের কত জন প্রাক্তন পুরপ্রধানের সুপারিশে টিকা পেয়েছেন, তারও কোনও স্পষ্ট হিসাব মেলেনি।
গোলমাল বাধতেই পুর কর্তৃপক্ষ অবশ্য লাইনে টোকেন বিলি করা দু’জনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ দিন ভিড়ের মধ্যে দেখা যায়, যাঁরা টিকা পাননি তাদের অনেকের হাতেই নম্বর লেখা কাগজের টুকরো। তাঁদের কাছ থেকেই জানা যায়, স্থানীয় দু’এক জন যুবক সেই ‘টোকেন’ বিলি করেছেন। অসীম সাহা বলেন, “ওই টোকেন আমরা দিচ্ছি না। তবে জানতে পারছি, স্থানীয় দু’এক জন দিচ্ছে। নারায়ণ বিশ্বাস ও খোকা দত্ত নামে দু’জন অর্থের বিনিময়ে টোকেন দিচ্ছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছি।” পুলিশ জানায়, অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছে।