নিজস্ব চিত্র।
প্রতিবন্ধকতা উড়িয়ে প্যারালিম্পিক্সে একের পর এক পদক জিতেছেন ভারতের ক্রীড়াবিদেরা। নদিয়ার ছেলেমেয়েরা খেলাধুলোয় কতটা এগোতে পারলেন, তার সুযোগই বা কেমন?
প্রতিবন্ধী দিবসে নাম কা ওয়াস্তে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ছাড়া সরকারি ভাবে প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের জন্য তেমন কোনও পরিকাঠামো নেই। নেই কোন সরকারি পুরস্কার বা ভাতার ব্যবস্থা। ওঁদের ভরসা বেসরকারি সংস্থা বা সংগঠন। কখনও কোনও প্রতিবন্ধী স্কুল আবার কখনও কোওন কল্যাণ সমিতির সীমিত সামর্থ্যে বাঁধা ওদের ক্রীড়ানৈপুণ্য।
এই নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে প্যারালিম্পিয়ান সাহেব হোসেনের। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ন্যাশনাল রেকর্ডধারী (১১.৪৪ সেকেন্ড) ক্রীড়াবিদ এ বার প্যারালিম্পিক্সে ভারতের সাফল্য প্রসঙ্গে বলেন, “ওই স্তরের খেলাধুলায় সফল হতে গেলে আরও কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং পরিকাঠামোগত জিনিসের দরকার হয়, যা পেলে হয়ত আমরা আরও ভাল কিছু করতে পারব।”
তবে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও যে অনেকটা করা গিয়েছে তার উদাহরণ সাঁতার। নদিয়ার এপিসি ব্লাইন্ড স্কুলের পড়ুয়াদের সাঁতারের দক্ষতা গোটা দেশ জানে। জাতীয় সাঁতার থেকে রাজ্য স্তরের প্যারালিম্পিক মিট, যেখানেই গিয়েছে তারা বেশির ভাগ পদক জিতে ফিরেছে। ২০১১-১২ সালে মহারাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত জাতীয় সাঁতার থেকে ১৫টি পদক এসেছিল। ২০১২-১৩ সালে চেন্নাইয়ে ২৪টি পদক, ২০১৩-১৪ সালে বেঙ্গালুরুতে ন্যাশনাল প্যারালিম্পিক সাঁতারে ২৬টি পদক, পরের বছর ইন্দৌরে ওই একই প্রতিযোগিতা থেকে এসেছিল ২৮টি পদক। সবচেয়ে বেশি পদক ন্যাশনাল প্যারালিম্পিক্সে ২০১৫-১৬ সালে কর্ণাটক থেকে জিতেছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা, মোট ৪২টি। কার্যত বাংলার কাছে দাঁড়াতে পারেনি কেউ। এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল ২০১৯ পর্যন্ত। তারপর করোনা কালে সবই থমকে গিয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “জেলার প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের নিয়ে যেমনই হোক তবু ধারাবাহিক কাজ হচ্ছিল। কিন্ত করোনার জন্য দুটো মরশুম কার্যত সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকটা পিছিয়ে গেল সব কিছু। ”
প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের নিয়ে কাজ করছে সিভিলিয়ান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনও। সংগঠনের সভাপতি শুভজিৎ মৌলিক তুলে ধরেন এক ঝাঁক প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদের কথা। যেমন রানাঘাটের আতর আলি। ২০০ এবং ৪০০ মিটার দৌড়ে প্রবল সম্ভাবনাময় এই দৌড়বীর ন্যাশনাল মিটে সাতটি পদকের মালিক হয়েও আপাতত একটি পার্লারে কাজ করেন রুটি-রুজির জন্য। করোনাকালে তাঁর অনুশীলন শিকেয়। ওয়েট লিফটিংয়ের সাকিনা খাতুন পাঁচ বছর আগে জেলা তথা রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়েছেন মহারাষ্ট্রে। নদিয়া ছেড়েছেন আজিজুর রহমান মোল্লা এবং সুফিয়া মোল্লা, এখন জাতীয় সাঁতারে তাঁরা প্রথম তিনের মধ্যে আছেন। এখন তাঁরা রাজস্থানের হয়ে নামেন। প্যারা ফুটবলার বিশ্বজিৎ দাস জাতীয় দলে খেলেন দিল্লির হয়ে। তালিকা দীর্ঘ।
শুভজিৎ বলেন, “এখানে ওদের তেমন কোনও সুযোগ নেই। আমরা আতর আলিকে দিল্লিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। আগামী দিনে যদি ও সফল হয় তখন যাবতীয় সাফল্য দিল্লির খাতায় নথিভুক্ত হবে। এখানে থাকলে ওর খেলাধুলো শেষ হয়ে যাবে।” প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নানা কাজে যুক্ত শুভজিৎ জানান, প্রায় এক দশক আগে সাঁতারু প্রশান্ত কর্মকার এ ভাবে অন্য রাজ্যে গিয়ে সফল হয়েছিলেন। তিনি কমনওয়েলথ গেমসে পদক জেতেন। তার পর থেকে অনেকেই সুযোগ পেলে চলে যাচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর নদিয়া জেলা সম্পাদক বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “নদিয়ার ছেলেমেয়েরা পানাপুকুরে সাঁতরে জাতীয় স্তরে পদক আনে। ওদের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। খাদ্য, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞানসম্মত পরিকাঠামোর কথা বাদই দিলাম, ভাল জুতো বা কস্টিউম পর্যন্ত পায় না ওরা। আমরা সাইয়ের কাছে পর্যন্ত দরবার করেছিলাম। কেউ কিছু শোনেনি। ও দিকে দিল্লি, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র বসে আছে ওদের নেওয়ার জন্য। তাই ওরাও চলে যাচ্ছে।”
গড্ডলিকা স্রোতে প্রতিভা ভেসে যেতে দেওয়ার ঐতিহ্য বঙ্গদেশে তো আজকের নয়। (শেষ)