Bangladesh Unrest

‘লড়াই কঠিন’ বলে দেশের পথে সাকিবুল 

জলিলের অবশ্য তখন জানা ছিল না যে ততক্ষণে তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ছেড়ে এই ভারতেই চলে এসেছেন।

Advertisement
সুস্মিত হালদার
গেদে  শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৪ ০৯:০৯
মায়ের সঙ্গে সাকিবুল। সোমবার গেদে সীমান্তে।

মায়ের সঙ্গে সাকিবুল। সোমবার গেদে সীমান্তে। ছবি: প্রণব দেবনাথ।

দীর্ঘ পথযাত্রার ধকল চোখে-মুখে স্পষ্ট। গলার স্বরে ক্লান্তি। মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রের কাউন্টার থেকে ভারতীয় টাকা নিয়ে সাবধানে জামার নীচে পেটের উপরে বাঁধা কাপড়ের ব্যাগে রাখতে রাখতে বছর সত্তরের আব্দুল জলিল বলেন, “ছাত্রদের বুকে গুলি করেছে। জাতি কোনও দিন সেটা মানতে পারে?”

Advertisement

জলিলের অবশ্য তখন জানা ছিল না যে ততক্ষণে তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ছেড়ে এই ভারতেই চলে এসেছেন। অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে সীমান্ত পার হতেই এতক্ষণ তিনি ব্যস্ত ছিলেন। সংবাদটা দিতেই চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে। সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেন, “এ বার দেশটার কপালে কী আছে, কে জানে?”

জলিলের বাড়ি নাটোর শহরে। ভারতের গেদে সীমান্ত থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে। সেই মাঝরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। গোটা দেশে বাস-ট্রেন বন্ধ। আট বার অটো বদল করে গেদে সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন। খরচ হয়েছে সাধারণ দিনের কয়েক গুন। কিন্তু খরচের দিকে তাকানোর উপায় নেই। অসুস্থ স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে বেঙ্গালুরু যেতেই হবে। তাই হাজার ঝুঁকি নিয়েও আসতে হয়েছে। পথে মিছিল দেখেছেন। দেখেছেন কোটা-বিরোধী ছাত্রদের জমায়েতও।

এ সব অবশ্য গত কিছু দিন ধরেই দেখছেন জলিল। তবে শনিবার সব মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। জলিল জানান, সে দিন বঙ্গজল ও মহারাজা হাই স্কুলের মাঠে কোটা-বিরোধী জমায়েতে হামলা চালায় সশস্ত্র ছাত্র লিগ ও যুব লিগ। তিনি বলেন, “চোখের সামনে ছাত্রদের মারা কিছুতেই মানতে পারছি না।” এর পর আর কথা না বাড়িয়ে স্ত্রীর হাত ধরে তিনি স্টেশনের দিকে হাঁটা দেন।

টাঙ্গাইলের বিপ্লব দত্ত আবার সীমান্তে এসেছেন দেশে ফিরতে মরিয়া হয়ে। তিনি কিডনির চিকিৎসার জন্য ভারতে এসেছিলেন। ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ। তার উপর দেশের যে অস্থির অবস্থা, তাতে পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। কিন্তু হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর কী পরিস্থিতি তা আঁচ করতে পারছেন না। তাই সোমবার রাতটুকু গেদেয় থেকে মঙ্গলবার সকালে ফেরার চেষ্টা করবেন, এমনটাই ভেবে রেখেছেন। বিপ্লব বলেন, “এই পরিস্থিতিতে স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মাকে ছেড়ে থাকা যায়? ওরা কেমন আছে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।” গেদের উল্টো দিকে, বাংলাদেশের দর্শনায় একটি ব্যাঙ্কে তাঁর ভাইয়ের বন্ধু আছে। দরকারে প্রথমে তাঁর কাছে গিয়ে উঠবেন, তার পর ঢাকা রওনা দেবেন, এমনটাই তিনি ভেবে রেখেছেন।

সাধারণ সময়ে গেদে চেকপোস্ট দিয়ে প্রতি দিন আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। এই ক’দিনে সংখ্যাটা কমতে কমতে একশো থেকে দেড়শোতে এসে ঠেকেছে। গেদের এক বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রের মালিক দীনবন্ধু মহলদার বলেন, “আজ মেরেকেটে দেড়শো জন হবে। এমন পরিস্থিতি শেষ কবে দেখেছি, মনে পড়ে না। বাংলাদেশ দ্রুত স্বাভাবিক না হলে আমাদেরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।”

এই অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেই দেশে ফিরতে মরিয়া কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সাকিবুল হাসান। মাকে নিয়ে তিনি হাজির হয়েছেন চেকপোস্টে। এসেছিলেন আত্মীয়ের বাড়ি। কিন্তু তাঁকে আজ ফিরতেই হবে। বন্ধু-সহপাঠীরা রাস্তায়। বিষণ্ণ মুখে সাকিবুল বলেন, “জানেন, আমার এক খুব কাছের বন্ধু পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে। নাম মনির হোসেন। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র ছিল।” তিনিও ছিলেন সে দিন আন্দোলনের পথে।

এ দিন চেকপোস্টে পৌ‌ঁছনোর আগেই হাসিনার দেশ ছাড়া আর সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের কথা সাকিবুলের জানা হয়ে গিয়েছে। ইমিগ্রেশন দফতর থেকে চেকপোস্টের দিকে যেতে যেতে তিনি বলেন, “এ বার আমাদের লড়াই আরও কঠিন হল।”

আরও পড়ুন
Advertisement