Babul Supriyo Indranil Sen

ইন্দ্রনীল বনাম বাবুল ম্যাচ আপাতত ড্র, বিধানসভায় কড়া ট্যাকল দেখে রেফারি হয়ে বিশ্বাস তৈরি অরূপের

সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজে বাবুল ও ইন্দ্রনীলকে পাশাপাশি নিয়ে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে ‘রাজ্য সঙ্গীত’ গেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে যে বরফ গলেনি তা স্পষ্ট হয়ে যায় বৃহস্পতিবার।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:১৯
( বাঁ দিক থেকে) বাবুল সুপ্রিয়, অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন।

( বাঁ দিক থেকে) বাবুল সুপ্রিয়, অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

বৃহস্পতিবার সকালে আবহাওয়া দেখে হুগলির এক তৃণমূল বিধায়ক বলেছিলেন, শীতকালীন অধিবেশন, না বাদল অধিবেশন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বিধানসভা কক্ষে বর্ষার ফুটবল মাঠে ম্যাচের মতো কড়া ট্যাকল শুরু হয়ে গিয়েছিল। ম্যাচ চলছিল দুই মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন এবং বাবুল সুপ্রিয়ের মধ্যে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। শেষ পর্যন্ত দু’জনকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দ্বন্দ্ব মিটেছে। আপাতত বাবুল বনাম ইন্দ্রনীল ম্যাচ ড্র!

Advertisement

বিধানসভায় বৃহস্পতিবার জিএসটি বিল নিয়ে আলোচনা চলছিল। পাশাপাশি বসেছিলেন অরূপ এবং ইন্দ্রনীল। আলোচনার একেবারে শেষ পর্বে দেখা যায়, বাবুল তাঁর নিজের আসন ছেড়ে অরূপের পাশে চলে গিয়েছেন। তার পর দেখা যায় ইন্দ্রনীলের উদ্দেশে তিনি কিছু বলছেন। এ-ও দেখা যায়, বাবুল যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর চোখেমুখে খানিক অনুযোগের ছাপ। এর মধ্যেই দেখা যায় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এসে দাঁড়িয়েছেন বাবুল-অরূপদের পিছনে। মিনিট দশেক সভাকক্ষের মধ্যে ট্রেজারি বেঞ্চে আলোচনা চলার পর চার মন্ত্রী কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়েন। ব্রাত্য চলে যান নিজের ঘরে। অরূপও নিজsর ঘরে চলে যান। তবে সঙ্গে নিয়ে যান যুযুধান ইন্দ্রনীল এবং বাবুলকে। অতঃপর আধ ঘণ্টার আলোচনা। যাকে তৃণমূলের অনেকে ‘শান্তিবৈঠক’ বলছেন। দরজা খোলার পর একটি ছবি প্রকাশ্যে আসে। যাতে দেখা যাচ্ছে পাশাপাশি বসে ইন্দ্রনীল-বাবুল। অরূপ নিজের চেয়ারে বসে রয়েছেন। ঠোঁটে হাসি। যুদ্ধ থামানোর তৃপ্তি। আপাতত।

বিধানসভায় অরূপ বিশ্বাসের ঘরে বাবুল সুপ্রিয় এবং ইন্দ্রনীল সেন।

বিধানসভায় অরূপ বিশ্বাসের ঘরে বাবুল সুপ্রিয় এবং ইন্দ্রনীল সেন। —নিজস্ব চিত্র।

কিন্তু কী কথা হল ভিতরে? তিন মন্ত্রীরই ফোনে এবং মুখে কুলুপ। অরূপকে প্রশ্ন করায় তিনি শুধু হেসেছেন। তবে তৃণমূলের অন্দরে বিষয়টি জানাজানি হয়েছে তো বটেই। সেই সূত্রই জানাচ্ছে, বাবুল তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী ইন্দ্রনীলকে বলেন, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে কেন তাঁকে এক বারও কাউকে সম্মান জানানোর জন্য ডাকা হল না। অথচ তিনি মঞ্চের একেবারে সামনেই বসেছিলেন। তিনি অনিল কপূরের সঙ্গে ১৯৯৩ সাল থেকে কাজ করেছেন, সলমন খানের সঙ্গে অন্তত দু’বার ‘ওয়ার্ল্ড ট্যুর’ করেছেন। পরিচালক মহেশ ভট্ট বলেছেন, তিনি বাবুলকে ‘মিস্’ করছেন। অথচ তাঁকে সেই মঞ্চে ব্রাত্য করে রাখা হল? যদিও চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনের দিন সলমন শহরে পৌঁছনোর পরে সরকারের তরফে তাঁকে স্বাগত জানাতে কলকাতা বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন বাবুল। কিন্তু ‘ওইটুকুতে’ তিনি যে সন্তুষ্ট নন, তা স্পষ্ট করে দেন বাবুল। বস্তুত, তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, বাবুল ইন্দ্রনীলকে এমনও বলেন যে, তাঁকে দর্শকাসনে স্রেফ বসিয়ে রেখে এক ‘জুনিয়র’ অভিনেত্রীকে একাধিক বার মঞ্চে তোলা হয়েছে সংবর্ধনা দেওয়ানোর জন্য।

তার পরেই অরূপ দু’জনকে নিজের ঘরে নিয়ে যান। সেখানে ‘চায়ে পে চর্চা’য় দু’জনেই বিবিধ বিষয়ে দু’জনের বক্তব্য বলেন। তিন মন্ত্রীরই ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন তৃণমূলের এক বিধায়কের কথায়, ‘‘দু’জনেরই অনেক কিছু বলার ছিল। মান-অভিমান ছিল। অনুযোগ-অভিযোগও ছিল একে অপরের সম্পর্কে। কিন্তু উভয় পক্ষেই খোলামনে কথাবার্তা হয়েছে। মনে হচ্ছে, বিষয়টা এখনকার মতো মিটে গিয়েছে।’’

ইন্দ্রনীল-বাবুল সম্পর্ক বরাবরই ‘মধুর’। দু’জনেই গায়ক। কিন্তু তালমিল হয়নি। বরং তাল ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল। বাবুল মন্ত্রিসভায় জায়গা পাওয়ার পরে ইন্দ্রনীলের হাতে থাকা পর্যটন দফতরটি তাঁকে দিয়েছিলেন মমতা। তার পর যত সময় এগিয়েছে, দু’জনের দ্বন্দ্ব বেড়েছে। গত মে-জুন মাস থেকেই শাসকদল ও সরকারের অনেকে ঘরোয়া আলোচনায় বলাবলি শুরু করেছিলেন, পর্যটন দফতরে বাবুলের কাজ নিয়ে ‘সন্তুষ্ট’ নন মমতা। তার পরে জুলাই মাসে একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেন মমতা। তাতে রাজ্যের পর্যটন উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান পদ থেকে আমলা নন্দিনী চক্রবর্তীকে সরিয়ে দেন তিনি। নন্দিনীর স্থলাভিষিক্ত করা হয় প্রাক্তন পর্যটন মন্ত্রী ইন্দ্রনীলকে।

তার পর দু’জনের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। যা গড়ায় বিধানসভা ভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে প্রকাশ্য বাদানুবাদে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে ইন্দ্রনীলকে বাবুল বলেন, ‘‘তুমি আমার দফতরের কাজ আটকাচ্ছ কেন? তুমি এ ভাবে সরকারি কাজ আটকে রাখতে পারো না! তুমি ফাইল পাঠানো বন্ধ করে দিলে কাজটা হবে কী করে!’’ শুনে ইন্দ্রনীল বাবুলকে বলেন, ‘‘তোর যা বলার তুই সেটা দিদিকে গিয়ে বল!’’ পাল্টা বাবুল বলেন, ‘‘সে আমি তো বলেইছি। যদি দরকার মনে করি আবার বলব। কিন্তু তুমি এ ভাবে আমার দফতরের কাজ আটকাতে পারো না।’’ পাল্টা ইন্দ্রনীল বলেছিলেন, ‘‘এখানে এ ভাবে কথা বলিস না তুই। তোর দফতরের কাজ কেন আটকাতে যাব! বললাম তো, তোর কিছু বলার থাকলে দিদিকে বল।’’

পরে ঘনিষ্ঠ মহলে ওই বাদানুবাদের কথা উল্লেখ করে স্বভাবরসিক ইন্দ্রনীল বলেছিলেন, তিনি বাবুলের অভিযোগের জবাবে সরকারি প্রকল্প ‘দিদিকে বলো’ এবং ‘দুয়ারে সরকার’-এর কথা বলেছিলেন। তবে দু’জনের সম্পর্ক সহজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাবুলের থেকে পর্যটন দফতরটি আবার ইন্দ্রনীলকে ফিরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রশাসনের একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, বাবুল নিজেই ‘বীতশ্রদ্ধ’ হয়ে পর্যটন দফতরের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন বলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। মমতা তাতে আপত্তি করেননি।

তবে দু’জনের সম্পর্কে ‘টানাপড়েন’ জারি থেকেছে। সম্প্রতি মমতা নিজে ইন্দ্রনীল-বাবুলকে পাশাপাশি নিয়ে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে ‘রাজ্যসঙ্গীত’ গেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে যে বরফ গলেনি, তা স্পষ্ট হয়ে যায় বৃহস্পতিবার। এ বারের বিষয় নেতাজি ইন্ডোরে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ। তবে সেই ‘দ্বন্দ্ব’ অরূপ আপাতত মেটাতে পেরেছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। অরূপের মুখের হাসিও তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, অরূপ ‘লাল কার্ড’ না দেখিয়েই পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পেরেছেন।

ম্যাচ কি শেষ হয়ে গিয়েছে? তেমন কিছু অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে তৃণমূলের লোকজন বলছেন, আপাতত ম্যাচ ড্র। অর্থাৎ, অমীমাংসিত। আপাতত।

আরও পড়ুন
Advertisement