হাকোলা হাইস্কুল। নিজস্ব চিত্র
কাছেই মেচেদা রেলস্টেশন। গ্রামের পাশে হলদিয়া-মেচেদা জাতীয় সড়ক। কিন্তু হাকোলা গ্রামের যাতায়াতের পথঘাট ভাল ছিল না। ঝোপ জঙ্গলে ভরা গ্রামে বাসিন্দার সংখ্যাও ছিল বেশ কম। বেশির ভাগই কৃষিজীবী। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত গ্রামের ছবিই ছিল এমন। তখনও মেচেদার কাছে কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং উপনগরী গড়ে ওঠেনি। হাকোলা ও আশপাশের গ্রামের ছেলে মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ ছিল। কিন্তু পরের ধাপে পড়তে হলে ছেলে মেয়েদের আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার দূরের স্কুলগুলোয় যেতে হত। গ্রামে হাইস্কুলের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন কয়েকজন উদ্যমী ও শিক্ষানুরাগী।
গ্রামবাসীদের যৌথ প্রচেষ্টায় হাকোলা জুনিয়র বেসিক স্কুলের সংলগ্ন জায়গায় হাইস্কুল গড়ার পরিকল্পনা হয়। বাঁশ, খড় ও টালি দিয়ে গড়ে ওঠে ছয় কক্ষ বিশিষ্ট বিদ্যালয় ভবন। সাহায্য করলেন গ্রামবাসীরা। ১৯৬৮ সালের ২ জানুয়ারি দু’টি ক্লাস বিশিষ্ট নতুন জুনিয়র হাইস্কুল তৈরি হল। শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হলেন গ্রামের শিক্ষিত বেকার যুবকেরা। স্কুলটি পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত জুনিয়র হাইস্কুল হিসেবে স্বীকৃতি পেল ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি।
নতুন হাইস্কুল গড়ায় গুণধর ভৌমিক, রামগোপাল ভৌমিক, হরেকৃষ্ণ মণ্ডল, হাকোলা জুনিয়র বেসিক স্কুলের প্রধানশিক্ষক সুধীরকুমার জানা, দেড়িয়াচক অরবিন্দ বিদ্যামঠের শিক্ষক নিরঞ্জন ঘড়া-সহ হাকোলা গ্রামের বহু বাসিন্দার বিশেষ অবদান রয়েছে। নতুন স্কুলের কার্যকারী সমিতির সম্পাদক ছিলেন গুণধর ভৌমিক। কার্যকারী সমিতি প্রধানশিক্ষক নিযুক্ত করেছিল হরেকৃষ্ণ দাসকে। ১৯৭০ সালে সরকারি অনুমোদনের পরে প্রথম প্রধানশিক্ষক হন রাসবিহারী জানা। সহ-শিক্ষক ধনঞ্জয় ভৌমিক, অজিতকুমার সিনহা, দুলালচন্দ্র বেরা, অজিতকুমার দাস। করণিক ছিলেন শ্যামচাঁদ মাইতি, দফতরি দুলালচন্দ্র আচার্য। অনুমোদনের পরে হাইস্কুলের পাকা দেওয়াল এবং টালির ছাউনি দেওয়া ঘর তৈরি হয়। নতুন বিদ্যালয় সরকারি পরিদর্শনের সময়ে ছাত্র ছাত্রীদের ভর্তির খাতা ও গ্রন্থাগারে বই দিয়ে সাহায্য করেছিলেন ভোগপুর কেনারাম হাইস্কুলের করণিক গৌরহরি বেরা।
হাইস্কুলের শুরুর দিকে গোষ্ঠবিহারী গুছাইত, রণজিৎকুমার মণ্ডল, সুজিত সিংহ, শিবানী দত্ত, রণজিৎ কুমার সামন্ত, শশাঙ্কশেখর মণ্ডল, অশোককুমার ভৌমিক, মধুসূদন মাইতি, মদনমোহন সাহু, মন্মথনাথ সী সংগঠক শিক্ষক শিক্ষিকা হিসেবে পাঠদান করেন। চণ্ডীচরণ জানা দফতরি এবং রবীন্দ্রনাথ জানা করণিক হিসেবে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছিলেন। প্রথমে স্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক হিসেবে ছিলেন গুণধর ভৌমিক। সভাপতি ছিলেন বসন্তকুমার ঘড়া। পরে সম্পাদক পদে রামগোপাল ভৌমিক, অতুলকৃষ্ণ ভৌমিক, জীবনচন্দ্র সামন্ত, গোকুলচন্দ্র দণ্ডপাট, পশুপতি মাইতি ও শুকদেব সামন্ত ছিলেন। ২০১৫ সাল থেকে প্রশাসক হিসেবে রয়েছেন তমলুক উত্তর চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক। বসন্তকুমার ঘড়ার পরে সভাপতি পদে ছিলেন মীনারানী চৌধুরী, শেখ মাজাহার আলি, সুশান্ত রায়, সব্যসাচী বর, উত্তমকুমার বেরা, সুকুমার মাইতি, রবিকান্ত সিমলাই, উত্তম পাত্র ও শেখ সাফায়েত আলি। প্রধানশিক্ষক রাসবিহারী জানা ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৩ সালে প্রধানশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্বপনকুমার পাত্র। ২০১২-১৮ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক ছিলেন মোহিতকুমার মিশ্র। বর্তমান প্রধানশিক্ষক দীপঙ্কর মাইতি ২০১৪ সালে প্রধানশিক্ষক হন।
জুনিয়র হাইস্কুল শুরুর পরে স্কুলে ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। হাকোলা ছাড়াও আশেপাশের গ্রামের অনেক ছাত্র ছাত্রী হাইস্কুলে ভর্তি হন। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই ১৯৭৩ সালে হাইস্কুলে নবম ও দশম শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়েছিল। সরকারি অনুমোদন পেতে প্রধানশিক্ষক ও পরিচালন সমিতি চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৭৫ সালে ‘বিশেষ অনুমতি’তে দশম শ্রেণির পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি মেলে। ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনুমতি মেলে। ২০০১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের স্বীকৃতি পেয়েছিল হাকোলা হাইস্কুল। ২০০৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর স্কুলে বৃত্তিমূলক শাখা শুরু হয়।
বর্তমানে বহুতল বিশিষ্ট হাইস্কুলের ‘ক্যাম্পাস’ বেশ সুসজ্জিত। বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পঠনপাঠনের পাশাপাশি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্রীড়া প্রশিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক চর্চায় বিশেষ জোর দেওয়া হয়। স্মার্ট ক্লাস রুম রয়েছে। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা ও ভূগোলের গবেষণাগারের সংস্কার করে উন্নত করা হয়েছে। ২০১৮ সালে স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী সাড়ম্বরে পালন করা হয়। সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে।
বিদ্যালয়ে বর্তমানে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। স্কুলে স্থায়ী শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ২৪ জন। এ ছাড়াও চার জন আংশিক সময়ের শিক্ষক রয়েছেন। অশিক্ষক কর্মী পাঁচ জন। ছাত্র ছাত্রীরা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষা ও পেশাগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এই স্কুলের প্রাক্তনী নারায়ণ দাস বর্তমানে খড়্গপুর আইআইটি-র অধ্যাপক। প্রসেনজিৎ গায়েন ভোপাল আইআইটি-র অধ্যাপক, বিশ্বজিৎ বেরা খড়্গপুর আইআইটিতে গবেষণারত। তাপসকুমার সী রাজস্থানের কোটায় গবেষণারত। মৌলি মণ্ডল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে গবেষণারত। রূপক মণ্ডল একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। পৃথ্বীরাজ সামন্ত চিকিৎসক হিসেবে রাশিয়ায় কর্মরত। এঁরা ছাড়াও চিকিৎসক, অধ্যাপক, শিক্ষক ও পুলিশ, প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে আধিকারিক পদে কর্মরত বহু প্রাক্তনী। বিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া সন্দীপ ভৌমিক, অঙ্কিতা ঘড়া বলেন, ‘‘স্কুলে পড়াশোনা খুব ভাল হয়। তবে আমাদের স্কুলের ক্যাম্পাসে সাইকেল রাখার সমস্যা রয়েছে। তাই কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হয়।’’ একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া ফারহা সুলতানা, রোহিত পাঁজা বলেন, ‘‘পড়াশোনা ভাল হয়। স্যারেরা খুবই সাহায্য করেন। তবে লাইব্রেরিতে আরও বই দরকার।’’
বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক দীপঙ্কর মাইতি বলেন, ‘‘বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীদের পাঠ্যসূচির পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটার শিক্ষা, খেলাধুলো ও সাংস্কৃতির চর্চার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। পড়ুয়াদের শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হয়। শিক্ষক শিক্ষিকা, অভিভাবক-সহ শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় পড়াশোনার ক্ষেত্রেও ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় আমাদের স্কুলের পড়ুয়াদের সাফল্য নজরকাড়ার মতো। আরও শ্রেণিকক্ষ-সহ পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন। বিশেষত পড়ুয়াদের সাইকেল স্ট্যান্ড, অডিটোরিয়াম, শারীরশিক্ষার জন্য জিমন্যাশিয়াম এবং পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে সরকারি সাহায্য খুবই প্রয়োজন।’’