Red ant eggs

কুরকুটের চাটনি খাওয়াবে একদা পিঁপড়ের ডিমে খিদে মেটানো আমলাশোল, চায় সরকারের সহযোগিতা

আমলাশোল-সহ বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ এখন লাল পিঁপড়ের ডিম বা কুরকুট বিক্রি করে স্বনির্ভর হতে চান। তাঁরা চান, এই কুরকুটের ব্যাপক বিপণনের ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
আমলাশোল (বেলপাহাড়ি) শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৪ ১৮:৫২
চলছে লাল পিঁপড়ের ডিম সংগ্রহ।

চলছে লাল পিঁপড়ের ডিম সংগ্রহ। — নিজস্ব চিত্র।

একদা যে খাবার তাঁদের পেটের খিদে মেটাত, ‘অনাহারের গ্রাম’ আমলাশোল সেই খাবারকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখছে দিনবদলের। লাল পিঁপড়ের ডিম বা স্থানীয় পরিভাষায় সেই ‘কুরকুট’ই আজ আমলাশোল-সহ বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকার ঘুরে দাঁড়ানোর হাতিয়ার। ভোটের মুখে তাই কুরকুটের ব্যাপক বিপণনের দাবি তুলছে একদা ‘অনাহারের গ্রাম’ আমলাশোল। কারণ, ইতিমধ্যেই রসেবশে থাকা বাঙালির পাতে নতুন ‘ডেলিকেসি’র তকমা পেয়ে গিয়েছে কুরকুটের চাটনি। জঙ্গলমহল চায়, তাদের সংগ্রহ করা কুরকুট যেন ছড়িয়ে পড়ে রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্র।

Advertisement

২০০৪ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর (এখন ঝাড়গ্রাম) জেলার ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন, শবর-মুন্ডা (মুড়া) অধ্যুষিত যে অখ্যাত গ্রামটি পাঁচ জন মানুষের ‘অনাহারে মৃত্যু’র পর খবরের শিরোনামে চলে এসেছিল, তার নাম আমলাশোল। শোনা যায়, আমলাশোলের মানুষ নাকি দিনের পর দিন স্রেফ লাল পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বাঁচতে বাধ্য হচ্ছিলেন। তার পর কেটে গিয়েছে দু’দশক। একদা প্রাণ বাঁচানো সেই লাল পিঁপড়ের ডিম বা কুরকুটই এখন কুলীন তকমা নিয়ে দামি রেস্তরাঁর মেনু কার্ডে। মাছেভাতে বাঙালির শেষ পাতেও উঠে এসেছে কুরকুটের চাটনি। আগে প্রোটিনে ঠাসা পুষ্টিকর সেই কুরকুটের চাহিদা ছিল মাছ ধরার টোপ হিসাবে। জঙ্গলবাসীদের খাদ্য হিসাবেও তার নাম ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সেই সীমিত গণ্ডি পেরিয়ে কুরকুট পৌঁছে গিয়েছে দেশ-বিদেশের থালায়। বহু আগে থেকেই লাতিন আমেরিকার মেক্সিকো বা ঘরের পাশে তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াতে চেটেপুটে খাওয়া হয় কুরকুট। ইদানীং তা শুরু হয়েছে ভারতেও। কুরকুটের বিশ্বায়নের স্বপ্নকে তাই যত্নে লালন-পালন করছেন আমলাশোল-সহ বেলপাহাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ।

পাতায়, ডালে কুরকুট।

পাতায়, ডালে কুরকুট। — নিজস্ব চিত্র।

জঙ্গলমহলের পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের মতো জেলাগুলির গ্রামীণ এলাকার অর্থনীতি আগের তুলনায় অনেকটাই ভাল। সেখানে বেশ ভাল দামে বিক্রি হচ্ছে কুরকুট। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্থানীয় কয়েক জন মানুষ নিয়মিত গ্রামে এসে কুরকুট কিনে নিয়ে যান। সেই কুরকুট তাঁরা আবার বিক্রি করেন কলকাতায়। এ ভাবে অনেকেরই আয়ের পথ খুলেছে। অনেকে পেশা হিসাবে বেছে নিচ্ছেন কুরকুটকে। তাঁরা চান এর ব্যাপক বিপণন। যাতে জঙ্গলমহলের কুরকুট সংগ্রহকারীরা সরাসরি তা পাঠিয়ে দিতে পারেন কলকাতা বা অন্যান্য শহরে। স্থানীয়দের দাবি, কলকাতা বা বড় শহরে কুরকুট বিক্রি হয় দেড় থেকে দু’হাজার টাকা কেজি দরে। কিন্তু আমলাশোলের বাসিন্দারা সেই কুরকুটই বিক্রি করেন কেজি প্রতি আড়াইশো টাকা থেকে চারশো টাকা দরে। বর্তমান প্রজন্ম চায়, এই তারতম্য দূর হোক। যাতে এই কারবারে আরও লাভের মুখ দেখা যায়।

আমলাশোলের বাসিন্দা আনন্দমোহন মুড়া বলেন, ‘‘কয়েক জন স্থানীয় ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা আমাদের কাছ থেকে নিয়মিত প্রচুর কুরকুট কিনে কলকাতায় বিক্রি করেন।’’ জোরামের গ্রামবাসী লক্ষ্মী মুর্মু বলেন, ‘‘জঙ্গল থেকে কুরকুট সংগ্রহ করে আনার পর ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান। আমরা জানি, শহরে এবং অন্যান্য জায়গায় কুরকুট অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়। এতে আমাদের জীবনযাপনে অনেকটাই সুবিধা হয়।’’ বেলপাহাড়ি বাজারের একটি জনপ্রিয় রেস্তরাঁর কর্ণধার বিধান দেবনাথ বলেন, “পর্যটকদের মধ্যে এই চাটনির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ঝাড়গ্রামের অনেক পর্যটক বিশেষ ভাবে কুরকুটের চাটনির জন্য অনুরোধ করেন। তার ব্যবস্থাও করা হয়। তবে, শুধু চাটনি তৈরি করছি না, তেজপাতা দিয়ে কুরকুটের ঝাল-ঝোলও তৈরি করছি।” দামের এই পার্থক্যের কারণে স্থানীয় লাল পিঁপড়ের ডিম সংগ্রহকারী গ্রামবাসীদের মুনাফা কম হচ্ছে। সরকার সঠিক ভাবে এর বিপণনের বন্দোবস্ত করলে এই সমস্যা আর থাকবে না। তখন কুরকুটের সঠিক দাম পাবেন ডিম সংগ্রহকারীরা। কুরকুটের জোগানও থাকবে সব জায়গাতেই। কাঁকড়াঝোড়ের একটি হোম-স্টের কর্ণধার অর্ণব সরকার বলেন, ‘‘বর্ষাকালে এই লাল পিঁপড়ের ডিম স্থানীয় বাজারে ৪০০-৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। আবার সেই জিনিসই শহরের বাজারে প্রায় দেড় হাজার থেকে দু’হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়।’’

প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালে বেলপাহাড়ির এই জোরাম গ্রামেই তৎকালীন বিরোধী নেত্রী তথা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসে কুরকুটের চাটনি খেয়েছিলেন। তাঁর ‘উপলব্ধি’ বইতে এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন মমতা। জঙ্গলমহলের এক বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ চান, মুখ্যমন্ত্রী যে খাবার খেয়েছিলেন গাছের ছায়ায় বসে, সেই খাবার পৌঁছে যাক দেশ-বিদেশের মানুষের পাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement