নানা বাহানা, বেসরকারির সঙ্গে সরকারি সাহায্য পাওয়া স্কুলেও প্রশ্নে শিক্ষার অধিকার
Government Schools

সরকার পোষিত স্কুলেও অনুদান আদায়

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:০৪
Representative Image

—প্রতীকী ছবি।

কয়েক বছর আগের কথা। ঝাড়গ্রাম জেলার একটি নামী সরকার পোষিত স্কুলে লটারিতে পড়ুয়া ভর্তির সুযোগ না মিললে এক চিকিৎসকের চেম্বার ছিল ভরসা। সেখানে অনুদান (ডোনেশন) দিতে হতো এবং তার জন্য কোনও রসিদ দেওয়া হতো না বলে অভিযোগ।

Advertisement

সরকার পোষিত স্কুলে ভর্তির জন্য বাড়তি টাকা নেওয়ার এমন নানা অভিযোগ মাঝে মধ্যেই আসে। মাস দুয়েক আগে ওই নামী স্কুলের এক প্রাক্তনী অনুদান নেওয়া নিয়ে সমাজমাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। ফলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে হইচই শুরু হয়। শুধু ঝাড়গ্রাম শহরের ওই নামী স্কুল নয়, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সরকার পোষিত নানা স্কুল বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে বাড়তি টাকা নিচ্ছে বলে অভিযোগ। কোনও ক্ষেত্রে আবার ভর্তির ক্ষেত্রে ঘুরিয়ে কোটার ব্যবস্থাও রয়েছে।

ঝাড়গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশন চত্বরে রয়েছে দু’টি বেসরকারি মর্নিং প্রাথমিক স্কুল। কুমুদকুমারী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি করে ৭০ জনকে নেওয়া হয়। স্কুল চত্বরের ওই দু’টি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুল থেকে ৪০ জন করে আরও ৮০ জনকে সরাসরি ভর্তি নেওয়া হয় সেখানে। ওই সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেক অভিভাবক ওই দু’টি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে মোটা ফি দিয়ে সন্তানদের ভর্তি করেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এমনটা হওয়ার কথা নয়। শুধু তাই নয়, ওই দু’টি প্রাথমিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ তালিকায় প্রথম ৪০ জনের নাম রাখা নিয়েও নানা অভিযোগ শোনা যায়। ওই দু’টি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে একটির পরিচালন সমিতির সদস্য মঙ্গলাশিস জানা অবশ্য বলছেন, ‘‘এসব মিথ্যা অভিযোগ। তদন্ত করে প্রমাণ দেওয়া হোক।’’

কুমুদকুমারীর বর্তমান প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ সেনগুপ্তের দাবি, ‘‘তিন বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছি। কখনই চাপ দিয়ে কোনও অভিভাবকের থেকে অতিরিক্ত অনুদান নেওয়া হয় না। স্কুলের উন্নয়ন তহবিলে স্বেচ্ছায় দান নেওয়া হয়।’’ ঝাড়গ্রাম ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়ে এ বছর পঞ্চম শ্রেণিতে লটারি হয়নি। সেখানকার প্রধান শিক্ষিকা অরুন্ধতী সেন জানান, পঞ্চম শ্রেণিতে দেড়শোটি আসন। এ বছর ১১০টি আবেদনপত্র বিক্রি হওয়ার কারণে লটারি করতে হয়নি। তবে তিনি মেনেছেন, ‘‘চলতি ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে অভিভাবক সভা ডেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে। রসিদের বিনিময়ে অনুদান নেওয়া হয়েছে।’’

শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর বিনা ব্যয়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। স্কুলগুলি ডেভেলপমেন্ট ফি বাবদ সর্বাধিক ২৪০ টাকা নিতে পারবে। কেউ যদি সেই টাকাও দিতে অক্ষম হন, তা হলে আবেদনের পরে পুরো ফি মকুব করা হবে। অথচ তা মানা হচ্ছে কই!

মেদিনীপুর শহরের এক অভিভাবকের আক্ষেপ, ‘‘৯০০-এর কিছু বেশি টাকা দিয়ে মেয়েকে খুব কষ্ট করে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছি। দিন মজুরির কাজ করি। স্কুলকে অনুরোধ করেও লাভ হয়নি।’’ দাসপুরের বৈকুন্ঠপুর এলাকার সৌমেন দোলাইয়ের অভিযোগ, ‘‘এখন আমি কলেজে পড়ি। দাসপুরের একটি স্কুলে পড়তাম। করোনা পরিস্থিতির পর স্কুল বাড়তি ফি নিয়েছিল।’’ এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই পথে নামে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলি। ডিএসওর ঘাটাল মহকুমার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা রবীন ভৌমিকের অভিযোগ, ‘‘গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলের স্কুলগুলির বিরুদ্ধে বাড়তি ফি নেওয়ার বেশি অভিযোগ ওঠে। নানা অজুহাতে সেই টাকা নেয় স্কুলগুলি।’’

যে সব সরকার পোষিত স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাদের যুক্তি, ছাত্র পিছু বছরে মাত্র ২৪০ টাকা দিয়ে সারা বছর স্কুল চালানো কষ্টকর। আনুষঙ্গিক খরচ চালাতেই ওই টাকা নেওয়া হয়। মেদিনীপুরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বলেন, “ভর্তির সময় হয়তো সরস্বতী পুজো বাবদ খরচের টাকা একসঙ্গে কেউ কেউ দিয়েছিল!’’ গড়বেতার একটি হাইস্কুলের শিক্ষক বলেই দিলেন, ‘‘স্কুল তহবিলের অবস্থা খুব খারাপ। এদিকে স্কুলের নিজস্ব খরচ বাড়ছে। তাই অভিভাবকদের সম্মতি নিয়েই বরাবরের মতো এবারও সরস্বতী পুজোর চাঁদাটা বাড়তি নেওয়া হয়েছিল।’’ খড়্গপুরের হিজলি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা স্কুলের সরস্বতী পুজো বাবদ ও সাইকেল স্ট্যান্ড বাবদ একটা বাড়তি টাকা নিই। এর বাইরে কোনও টাকা নেওয়া হয় না। ভর্তির ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় মুক্ত হস্তে দানের কথা বলি। সেটা একেবারেই বাধ্যতামূলক নয়।’’ (চলবে)

(তথ্য সহায়তা: কিংশুক গুপ্ত, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, অভিজিৎ চক্রবর্তী, বরুণ দে, দেবমাল্য বাগচী)

আরও পড়ুন
Advertisement