মন্দিরময় পাথরা। —নিজস্ব চিত্র।
লায়েক -চুয়াড় বিদ্রোহের পীঠস্থান গড়বেতার গনগনি, ক্ষুদিরাম বসুর স্মৃতি বিজড়িত কেশপুরের মোহবনি, রানি শিরোমণির কর্ণগড়, নাড়াজোল, কেশিয়াড়ির কুরুমবেড়া দুর্গ, দাঁতনের মোগলমারি বৌদ্ধবিহার, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল'-এর রচনাস্থল আনন্দপুরের আড়রা গ্রাম বা 'শিবায়ন' কাব্যগ্রন্থের রচনাস্থল কর্ণগড়ের দণ্ডেশ্বর শিবমন্দির— পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এ সব নানা কেন্দ্রের সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্য আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকলেও, পর্যটনের বিকাশ সে অর্থে হয়নি। সরকারি স্তরে বিক্ষিপ্ত ভাবে কোথাও কোথাও পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে বটে তবে সার্বিক ভাবে পর্যটনের প্রচার ও প্রসারে সরকারের কাছে কার্যত দুয়োরানি হয়েই রয়ে গিয়েছেএই জেলা।
ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি। সে অর্থে এখানে নেই কোনও ইতিহাস বা ঐতিহ্য। অথচ এই বেলপাহাড়িই এখন সপ্তাহান্তে পর্যটকদের ছুটি কাটানোর অন্যতম গন্তব্য। স্রেফ নৈসর্গিক টানেই তাঁরা ছুটে আসেন এখানে। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হবে এর জনপ্রিয়তা। জেলায় এখন সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি হোমস্টে রয়েছে ১০২টি। যার অর্ধেক (৫০টি) বেলপাহাড়ি ব্লক এলাকায়। ব্যবসায়িক উদ্যোগ বদলে দিয়েছে বেলপাহাড়িকে। ইতিহাসের ঘাটতি পূরণ করেছে প্রকৃতি। বেলপাহাড়ি টুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র বিধান দেবনাথ বলছেন, ‘‘ব্যবসায়িক কারণে হোম স্টে গুলি প্রাকৃতিক নৈসর্গিক এলাকায় তৈরি হয়েছে। এর ফলে সেখানে মরশুমে প্রচুরপর্যটক যাচ্ছেন।’’
পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক স্থান। মোগলমারি বৌদ্ধবিহার, শরশঙ্কা দিঘি, ঐতিহাসিক মনোহরপুর রাজবাড়ি ছাড়াও আছে একাধিক প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য মূর্তি। যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তবে নেই কোনও ব্যবস্থা। ষোড়শ শতাব্দীর মোগলমারি বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন এলাকায় মিউজিয়াম ও বিশ্রামাগার গড়ে তোলার কাজে রাজ্য সরকার উদ্যোগী হলেও তা অজানা কারণে তা এখনও হয়নি। মোহনপুরে রয়েছে পাঁচশো বছরের প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির। রয়েছে ঐতিহাসিক আঁতলা মসজিদ। কেশিয়াড়ির গগনেশ্বরে অবস্থিত কুরুমরেড়া দুর্গ। যাকে ঘিরেও পর্যটন সম্ভাবনা প্রবল। তবে সে সম্ভাবনা কালের গর্ভে ঘুমিয়ে।কেশিয়াড়ির কুমারহাটিতে রয়েছে একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি জগন্নাথ মন্দির। পড়ে আছে অবহেলায়। সংস্কারের অভাবে ঐতিহাসিক ও পৌরানিক স্থাপত্যগুলি এখন ক্ষয়ের পথে।
বেলপাহাড়ির পর্যটনের আকর্ষণীয় উন্নতি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারেনি ইতিহাস সম্পৃক্ত লালগড়ের কাছে। কংসাবতী নদীর কূল ঘেঁষা লালগড় ব্লক সদরে রয়েছে কয়েকশো বছরের পুরনো লালগড় রাজপ্রাসাদ, রাজ পরিবারের কুলদেবতা রাধামোহনের মন্দিরটিও অনুপম জোড়বাংলা শৈলির ভাস্কর্যের নির্দশন। রয়েছে রাজাদের বহু প্রাচীন ‘হাওয়া মহল’। চারশো বছরের পুরনো দুর্গা মন্দিরে দুর্গার বিগ্রহটি দেওয়ালে খোদাই করা। এ জন্য বলা হয় 'দেওয়ালি দুর্গা'। নেতাই গ্রামের অদূরে ডাইনটিকরি গ্রামে রয়েছে ভগ্নপ্রায় জৈন মন্দির। লালগড় থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে রামগড়ের রাজপ্রাসাদটির ধ্বংসাবশেষ চত্বরে রয়েছে রামগড় রাজ পরিবারের কয়েকশো বছরের কালাচাঁদ মন্দির। এ ছাড়াও রামগড়ের রাজাদের রাসমন্দিরও কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসের সাক্ষ্যবহন করছে। রামগড়ের অদূরে রয়েছে বনদেবী ‘মা মৌজি’র মন্দির। এটিও কয়েকশো বছরের পুরনো। অথচ বেলপাহাড়ির পর্যটনের হাজার ওয়াটের আলো থেকে বিন্দু মাত্র ঠিকরে পড়েনি এ সব জায়গাগুলিতে। পড়লে হয়তো জ্বলত টুনি বাল্ব। লালগড়ের লোকসংস্কৃতি গবেষক পঙ্কজকুমার মণ্ডলের আক্ষেপ, ‘‘ইতিহাস সমৃদ্ধ বহু নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও লালগড় ও রামগড়কে জেলার পর্যটন মানচিত্রে শামিল করা হয়নি। সরকারিস্তরে লালগড়েরপ্রচার নেই।’’
সরকারি স্তরে প্রচার একদম যে হয়নি তা নয়। তবে তার ধারাবাহিকতা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়। পশ্চিমের মন্দিরময় পাথরা যেন প্রতি পদে ইতিহাসের হাতছানি। পাথরাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। অর্থও দিয়েছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক কিছু নষ্ট হচ্ছে। শালবনির কর্ণগড়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হতে বসেছিল রানি শিরোমণির এই গড়। রানি শিরোমণির নেতৃত্বে চুয়াড় বিদ্রোহের ইতিহাস বহন করে চলেছে শালবনির এই অঞ্চল। দুর্গ না থাকলেও তার অংশ বিশেষ রয়েছে। দুর্গের সেই অংশ বিশেষও আগাছায় ভরে গিয়েছিল। বছর কয়েক আগে সংস্কারের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। সেই উদ্যোগ অবশ্য পরিকল্পনা, প্রস্তাবেই আটকে থেকে গিয়েছিল। বছর দুয়েক আগে কর্ণগড় মন্দিরের উন্নয়নে এক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বরাদ্দে সেজে উঠেছে মন্দির ও তারআশেপাশের এলাকাও।
পশ্চিমের ঘাটালের বীরসিংহকে ইতিমধ্যেই পযর্টন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিকাঠামো সহ সৌন্দযার্য়নের একগুচ্ছ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। বীরসিংহে পার্ক, স্মৃতি মন্দিরের আমূল সংস্কার হয়েছে। রাস্তাঘাটের হাল ফিরেছে। তবে এখনও সরকারি ভাবে কোনও বিশ্রামাগার তৈরি হয়নি। ইতিহাসে মোড়া নাড়াজোল রাজবাড়ি পযর্টন কেন্দ্রের এক বিশাল সম্ভাবনা ছিল। এখনও তার নানা স্মৃতিছড়িয়ে রয়েছে। পুরাতত্ব বিভাগ হস্তক্ষেপ করলেও পযর্টনস্থল হিসাবে মযার্দা পায়নি। ইতিহাসের বাজার চিরকালই মন্দা। অগত্যা দুয়োরানি-সুয়োরানির রূপকথা পুনঃসম্প্রসারিত হয়েই চলছে।
(তথ্য: বরুণ দে, কিংশুক গুপ্ত, অভিজিৎ চক্রবর্তী, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, বিশ্বসিন্ধু দে)