মেদিনীপুর শহরে মাথা তুলছে বহুতল। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
বছর দেড়েক আগে রেলশহরের উপকণ্ঠে শিল্পতালুকের একটি সরকারি কটেজে প্রশাসনিক বৈঠক করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান কে আছেন প্রশ্ন করতেই উঠে দাঁড়ান বিধায়ক দীনেন রায়। এরপরে ওই কটেজ সংলগ্ন জমিতে নির্মীয়মাণ আটতলা বহুতল নিয়ে প্রশ্ন করেন মুখ্যমন্ত্রী। দীনেন তা এড়িয়ে প্রাক্তন চেয়ারম্যানের সময়ে সেটির অনুমতি বলে দাবি করলেও উষ্মা প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও ওই বহুতলে বিক্রি হওয়া ফ্ল্যাটবাড়িতে এখন নির্বিঘ্নেই বসবাস চলছে।
মুখ্যমন্ত্রীর বহুতল উদ্বেগ অবশ্য এরপরেও দেখা গিয়েছে। মাস কয়েক আগে মেদিনীপুরে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তখন মেদিনীপুরের মতো তুলনায় ‘ছোট’ শহরে এত উঁচু উঁচু বহুতল দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। এক বৈঠকে পুরপ্রধান সৌমেন খানকে কার্যত বকাঝকাও করেছিলেন তিনি। শহরে বেআইনি নির্মাণ বরদাস্ত করা যাবে না, পুরপ্রধানকে স্পষ্ট বুঝিয়েছিলেন তিনি। যদিও এরপরেও পরিস্থিতি বদলায়নি বলেই দাবি। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার প্রতিটি শহর থেকে কয়েকটি গ্রামীণ এলাকায় বহুতলের বাড়বাড়ন্ত অন্তত এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২৪ জুন পুরসভাগুলিকে নিয়ে বৈঠকে বহুতল নিয়ে কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দেন। তারপরেও দুই জেলার অধিকাংশ পুরসভাই বহুতলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ। বেআইনি বহুতলগুলি থেকে যেকোনও সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে আশঙ্কা।
খড়্গপুর পুরসভা দায় এড়িয়ে রাজ্যের নগরোন্নয়ণ দফতর থেকে বহুতল নির্মানের অনুমতি আদায়ের দাবি করলেও নিয়মনীতি রক্ষার দায়িত্ব কার সেই প্রশ্ন উঠছেই। খড়্গপুর শহরের ঘিঞ্জি গলিপথেও ১০-১২ তলা বহুতল গজিয়ে উঠছে। সেখানে নিয়ম মেনে যে পরিমাণ জমি ছাড়তে হয় তা কোথাও হচ্ছে না বলে অভিযোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না অগ্নিনির্বাপন বিধিও। মুখ্যমন্ত্রী বলার পরে শহরের ইন্দার ঠাকুরচক সংলগ্ন গলিপথে রেলের সীমানা এলাকায় নির্মীয়মাণ একটি বহুতল পরিদর্শন করেন পুরপ্রধান-সহ পুরপ্রতিনিধিরা। তবে ওই পর্যন্তই। ইন্দা, ঝাপেটাপুর, মালঞ্চ, খরিদা, কৌশল্যা এলাকায় একের পর এক বহুতল নিয়মনীতি না মেনে গজিয়ে উঠলেও পুরসভা কার্যত চোখ বন্ধ করেছে বলে দাবি শহরবাসীর একাংশের। মুখ্যমন্ত্রী বলার পরেও কেন এমন উদাসীনতা? পুরপ্রধান কল্যাণী ঘোষ বলেন, “আমরা তো ছ’তলা পর্যন্ত অনুমতি দিই। এর বাইরে তো সব নবান্ন থেকেই অনুমতি নিয়ে আসছে। তবে রাস্তা থেকে জায়গা না ছাড়ার মতো নিয়ম যেখানে ভঙ্গ হচ্ছে সেটা আমরা এ বার দেখব।”
গত কয়েক বছরে বহুতলে ছেয়ে গিয়েছে মেদিনীপুরও। এই শহরে থাকা জলাভূমিগুলিও একাংশ প্রোমোটারের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে! শহরবাসীর একাংশ মনে করাচ্ছেন, ‘‘কোনও বেআইনি নির্মাণ একদিনে মাথা তোলে না। বিপজ্জনক বহুতল তৈরি হওয়া ঠেকাতে পুরসভার উচিত কড়া পদক্ষেপ করা।’’ মেদিনীপুরের মতো শহরে জি-প্লাস ৬ (সাততলা)- এর চেয়ে উঁচু বাড়ি হওয়ার কথা নয়। যদিও এই শহরে ১০ তলা, এমনকি ১২ তলার বহুতলও গড়ে উঠেছে। কোনও অজ্ঞাত কারণে পুরসভা ব্যবস্থা নেয় না বলেই অনুযোগ। পুরপ্রধান সৌমেন খানের অবশ্য দাবি, বেআইনি বহুতল তৈরি রুখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে।
মেদিনীপুর পুরসভা সূত্রে খবর, শহরে কোনও বহুতল তৈরি করতে হলে এ বার থেকে তার সামনে অনুমোদিত নকশা-সহ বোর্ড লাগিয়ে লিখে রাখতে হবে জমির মালিক এবং প্রোমোটারের নাম। এক পুর আধিকারিক বলেন, ‘‘অনুমোদিত নকশায় বিচ্যুতি বেশি হলে সেগুলিকে কোনও ভাবেই আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। যাঁরা ওই বহুতলে ফ্ল্যাট কিনবেন, তাঁরা মিউটেশন করাতে পারবেন না।’ বেআইনি বহুতল চিহ্নিত করা হবে।’’ যদিও এমন আশ্বাস পুরসভা আগে দিলেও বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি বলে জেলা সদরের বাসিন্দাদের দাবি।
ঘাটালের মতো শহরে এতদিন সে ভাবে বহুতলের রেওয়াজ চালু হয়নি। তবে ইদানিং একের পর এক বহুতল ভবন মাথা তুলছে সেখানে। অভিযোগ, সেগুলির অধিকাংশই বেআইনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আবার খাতায় পাওয়া অনুমতির থেকে অতিরিক্ত তলবিশিষ্ট বহুতল উঠছে। পুরসভার নজরদারি থাকছে না বলে অভিযোগ। ঘাটাল পুরসভার চেয়ারম্যান তুহিনকান্তি বেরা বলেন, “ঘাটাল পুরশহরে বহুতল সে ভাবে তৈরি হয়নি। বিক্ষিপ্ত ভাবে কোথাও কোথাও হচ্ছে। পুরসভার অনুমতি না নিয়ে এমন বহুতল রয়েছে কি না, তা দেখা হচ্ছে।”
ঝাড়গ্রাম শহরে পুরনো বাড়ি ভেঙে এবং ফাঁকা রায়তি জমিগুলিতে একের পর বহুতল মাথা তুলছে। কিন্তু কেমন উপকরণ দিয়ে ওই সব বহুতল তৈরি হয়েছে কিংবা হচ্ছে— তার কোনও তত্ত্বতালাশ করা হয়নি। পুরনো বহুতলগুলির পরিকাঠামোর উপরে নজরদারি চালানোর জন্য ভোটের আগে পুরসভার উদ্যোগে নজরদার কমিটি তৈরি হয়েছে। ঝাড়গ্রাম শহরে প্রথম বহুতল তৈরি হয় ১৯৯৬ সালে। পুরসভার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন শহরে বহুতলের সংখ্যা ১১২টি। এর মধ্যে কয়েকটি বাণিজ্য কেন্দ্র ও হোটেল রয়েছে। পুরনো বহুতলগুলিতে লিফটও নেই। অনেক পুরনো বহুতলে আগুন নেভানোর কোনও ব্যবস্থাও নেই। কিছু বহুতলে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও দিয়ে ‘অয়্যারিং’ করানো হয়েছে। পুরসভার এক সূত্রে জানা গিয়েছে, আগের তুলনায় চলতি পুরবোর্ডে বহুতল নির্মাণে কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। ঝাড়গ্রামের পুরপ্রধান কবিতা ঘোষের দাবি, সব দিক দেখেই বহুতলের অনুমোদন দেওয়া হয়। শেষ
(দেবমাল্য বাগচী, বরুণ দে, অভিজিৎ চক্রবর্তী,
কিংশুক গুপ্ত, রঞ্জন পাল)