মোচপোল এলাকার যে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে তার পাশের লাগোয়া বাড়ির দেওয়ালে রক্তের দাগ। —নিজস্ব চিত্র।
মাত্র চার বছরেই তৈরি হয়ে গিয়েছে তাঁর ‘বাজির সাম্রাজ্য’। অথচ, পুলিশ জানেই না! এমনকি, তাঁকে থানায় ডেকে এ ব্যাপারে কখনও জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। অভিযোগ, কয়েক মাস আগেই দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাজি বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনার সারা রাজ্য জুড়ে বেআইনি বাজির খোঁজে তল্লাশির সময় তাঁর এলাকা থেকেই কোটি টাকার বাজি উদ্ধার হলেও পুলিশ তাঁকে ছোঁয়নি! উল্টে তাঁর এমনই প্রভাব যে, গণ-স্বাক্ষর করে স্থানীয়দের কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জমা দিতে গেলেও হিতে-বিপরীত হয়েছে। অভিযোগ, স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে থেকেই ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ!
রবিবার দত্তপুকুর থানা এলাকার নীলগঞ্জ মোচপোলের বাজি বিস্ফোরণের ঘটনার পর ওই এলাকার বেআইনি বাজি কারখানার মাথা আজিবর রহমানের বিরুদ্ধে এমনই সব অভিযোগ সামনে আসছে। ঘটনার পর থেকেই তিনি সপরিবার পলাতক। ক্ষুব্ধ জনতা এ দিন তাঁর বাড়ি ভাঙচুর করে। এতেই বেরিয়ে এসেছে তাঁর বাড়িতে মজুত রাখা বস্তা বস্তা বাজি এবং বাজি তৈরির উপকরণ। প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিমাণ বাজি এবং বাজি তৈরির উপকরণ মজুত থাকলেও স্থানীয় দত্তপুকুর থানা কি কিছুই জানে না? প্রশ্ন উঠেছে, বাজি কারবারকে ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা এবং শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের অবস্থান নিয়েও। এই প্রশ্ন আরও উস্কে দিয়েছে স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষের একটি মন্তব্য। তিনি দাবি করেছেন, এখানে যে বাজি কারখানা চলছে, তা তিনি জানতেনই না! তাঁর বক্তব্য, ‘‘আগে জানলে পুলিশকে পদক্ষেপ করতে বলতাম।’’
এমন প্রশ্ন অবশ্য দত্তপুকুরেই শুধু উঠছে না। সম্প্রতি একাধিক ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসন এবং শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের ভূমিকা নিয়ে মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি হয়ছে।
চলতি বছরের ১৬ মে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় স্থানীয় তৃণমূল নেতা ভানু বাগের বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের পরেও এমনই অভিযোগ উঠেছিল। ওই ঘটনায় এগরা থানা আইসি বদল হয়। জানা যায়, কয়েক বছর আগেও গ্রেফতার হয়েছিলেন ভানু। কিন্তু তার পরেও এই ‘মারণ ব্যবসা’ বন্ধ করেননি।
কিছু দিন আগে মহেশতলায় একটি বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণেও একই অভিযোগ ওঠে। সেখানে তিন জন মারা যান। পুলিশ কারখানার মালিক ভরত হাতিকে গ্রেফতার করলেও বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত। ভরত নিজেই এ দিন বলেন, ‘‘ওই কাজ ছাড়া আর তো কিছু জানি না।’’
বেআইনি বাজি তৈরির জন্য কুখ্যাত এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, মূলত দু’টি কারণে চট করে এমন ব্যবসা ছাড়েন না কেউ। প্রথমত, এতে তিন, চার গুণ বেশি লাভ। দ্বিতীয়ত, ধরা পড়লেও কড়া শাস্তি না হওয়ার নিশ্চয়তা। তাঁরা জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রেফতারির পর ‘এক্সপ্লোসিভ সাবস্ট্যান্সেস আইনে’ মামলা করা হয় না। পুলিশ জেল হেফাজতের দাবি জানায়। মামলায় দেখানো হয়, বাজি তৈরির সময় নয়, বাজি ফেটে দুর্ঘটনা। সিজ়ার তালিকা প্রায় থাকেই না। ফলে চট করে জামিন মেলে।
এমনিতে ১৫ কেজি পর্যন্ত বাজি এবং বাজির মশলা তৈরির ক্ষেত্রে লাইসেন্স নিতে হয় জেলাশাসকের কাছ থেকে। ১৫ থেকে ৫০০ কেজি হলে ‘কন্ট্রোলার অব এক্সপ্লোসিভস’-এর কাছ থেকে এবং তারও বেশি ওজনের বাজির ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্স দেন ‘চিফ কন্ট্রোলার’। পাশাপাশি, প্রতিটি কারখানা ১৫ মিটার দূরে হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে বাজির মশলা তৈরি, বাজি তৈরি এবং বাজি প্যাকেটবন্দি করার কাজও আলাদা ভাবে করতে হয়। কিন্তু অভিযোগ, এই সব নিয়মের সবটাই থেকে যায় শুধুই খাতায় কলমে।
হুগলির বেগমপুরে যেমন বাজি কার্যত কুটিরশিল্প। শ্রমিকদের একাংশের বক্তব্য, মহাজনের মাধ্যমে তাঁরা বাজি তৈরি করেন। পুজো সামনে আসতেই সেখানে ঘরে ঘরে বাজি তৈরির গতি বেড়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় ২০১৫ সালের ৬ মে রাতে একটি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তিন অভিযুক্তকে সম্প্রতি ১৫ বছর কারাদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে মেদিনীপুর আদালত। বাজি তৈরি বন্ধও হয়নি। সাজাপ্রাপ্তদের পরিবারের দাবি, যে কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছিল, সেখানে পুলিশ ও শাসক দলের লোকজন এসে নিয়মিত টাকা নিয়ে যেত।
পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অমরনাথ কে অবশ্য বলেন, ‘‘বেআইনি বাজির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।’’ পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি জানান, ক্লাস্টার এবং হাব তৈরির কাজ শেষ হলে বেআইনি বাজি তৈরির প্রবণতায় রাশ টানা যাবে। বারাসতের ঘটনার পরে একই দাবি সেখানকার জেলাশাসক শরদকুমার দ্বিবেদীরও। বারাসত পুলিশ জেলার সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যাঁরই গাফিলতি থাক, সব দিক খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
কিন্তু এত দিন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? স্পষ্ট উত্তর মেলে না।