প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী। ফাইল চিত্র।
সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসের জয় তামাম বঙ্গ রাজনীতিকে আন্দোলিত করেছিল। ও-টু (অক্সিজেনের রাসায়নিক নাম) নার্সিংহোমের মালিক বাইরনের জয়ে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র অক্সিজেন পেয়েছিল সিপিএম-কংগ্রেস। তাতে ভর করেই অধীর চৌধুরির জেলায় পঞ্চায়েত ভোটে ঝাঁপিয়েছিল ‘জোট’। শনিবার ভোট শেষ হয়েছে। কিন্তু রবিবার জেলার বাম-কংগ্রেস নেতাদের গলায় কোনও ঝাঁজ নেই। বরং ঘরোয়া আলোচনায় তাঁরা স্বীকারই করে নিচ্ছেন, জেলা পরিষদ জয়ের আশা দেখছেন না। এ দিক-ও দিক থেকে জেলা পরিষদের কিছু আসন বেরোতে পারে। তবে ৭৮ আসনের মধ্যে তা নেহাতই হাতেগোনা।
মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের এক নেতা যেমন রবিবার বললেন, ‘‘বেশ কিছু জায়গায় তৃণমূল ভোট করতে দেয়নি। তবে যে সমস্ত জায়গায় ভোট হয়েছে, সেখান থেকেও জেলায় রিপোর্ট আসেনি।’’ এর অর্থ কী? ওই কংগ্রেস নেতার কথায়, ‘‘বুথ স্তরে সংগঠনের যে ন্যূনতম শক্তি দরকার, তা গড়ে তোলা যায়নি।’’ তবে পাশাপাশিই তাঁর এ-ও দাবি, অতীতের তুলনায় এ বার অনেক জায়গায় ‘শাসকের সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ’ গড়ে তোলা গিয়েছে।
মুর্শিদাবাদ জেলা সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা আবার ভোটের দিন কংগ্রেসের ‘ভূমিকা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। ‘জোটসঙ্গী’র বিরুদ্ধে কিছুটা আক্রমণ শানিয়েই তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেস তো ভোটের দিন ময়দানেই ছিল না! পালিয়ে গিয়েছিল। ওদের যেখানে শক্তি রয়েছে, সেখানে তো ওদের দেখাই যায়নি।’’ কিন্তু তাঁরা কী করলেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কিছু জায়গায় আমরা প্রতিরোধ গড়ে তেলার চেষ্টা করেছি। তার ফলও মিলেছে। তবে বেশির ভাগ জায়গাতেই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।’’
অর্থাৎ, মুর্শিদাবাদের বাম এবং কংগ্রেস নেতারা কার্যত মেনেই নিচ্ছেন, বুথ স্তরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার মতো মজবুত সংগঠন এখনও তাঁরা খাড়া করতে পারেননি। তবে প্রকাশ্যে জেলার বাম-কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, হারার আগে হারবেন না।
রাজনীতির কারবারিদের বক্তব্য, শনিবার ভোটপর্ব মেটার পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরির কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, নিজের জেলায় তিনি সে ভাবে ‘ভোট করাতে’ পারেননি। ভোটের পর তিনি সরাসরিই বলেছিলেন, ‘‘দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়), আপনাকে অভিনন্দন। এই হিংসাত্মক পঞ্চায়েত ভোট আপনি জিতে গিয়েছেন।’’ সেই সূত্রেই অনেকে আগামী লোকসভা ভোটে অধীরের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়েও খানিকটা উদ্বেগে। কারণ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হলেও আসলে তাঁর ‘পাখির চোখ’ নিজের জেলা মুর্শিদাবাদ। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, বহরমপুর।
জেলা কংগ্রেসের এক অধীর-ঘনিষ্ঠ নেতার কথায়, ‘‘শনিবার থেকে দাদার মেজাজ ঠিক নেই। কিছুটা মুষড়েই রয়েছেন।’’ ২০১৯ সালের ভোটে অধীরকে বহরমপুরে হারাতে কার্যত আদাজল খেয়ে নেমেছিল তৃণমূল। শুভেন্দু অধিকারীকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিল কালীঘাট। জেলার বাকি দু’টি লোকসভা কেন্দ্র মুর্শিদাবাদ ও জঙ্গিপুরে শুভেন্দু জোড়াফুল ফোটাতে পারলেও অধীর নিজের ‘গড়’ ধরে রেখেছিলেন। তবে ২০১৪-র তুলনায় তাঁর জয়ের ব্যবধান অনেকটাই কমে গিয়েছিল সে বার। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও বহরমপুর লোকসভার অন্তর্গত কয়েকটি বিধানসভায় থাবা বসিয়েছিল বিজেপি। অধীর শিবিরের অনেকের বক্তব্য, এ বার শুভেন্দু তৃণমূলে নেই। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুরকে ‘টার্গেট’ করেছেন। তাই চাপ কিছুটা বেশিই। পঞ্চায়েতে আশানুরূপ ফল না হলে তার অভিঘাত সংগঠনে পড়বে। তার প্রভাব পড়তে পারে লোকসভা ভোটে।
বাম-কংগ্রেস নেতাদের কথা এবং গলার স্বরে যতটা হতাশা, তৃণমূল ততটাই উচ্ছ্বসিত। তৃণমূলের বহরমপুর সাংগঠনিক জেলার সভানেত্রী শাওনি সিংহ রায় রবিবার বলেন, ‘‘জেলা পরিষদ জয়ের ব্যাপারে আমরা ২০০ শতাংশ আশাবাদী। আমাদের লড়াইটা সিপিএম, কংগ্রেস বা বিজেপির সঙ্গে নয়। আমরা সাংগঠনিক ভাবে যে ফলাফল আশা করেছি, তা পেলাম কি না সেটাই আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ।’’
বহরমপুর সাংগঠনিক জেলার মধ্যে জেলা পরিষদের ৪৭টি আসন রয়েছে। শাওনির দাবি, অন্তত ৪০টি আসন তৃণমূল জিতবে। সাগরদিঘির উপনির্বাচনকেও ‘অতীত’ হিসেবেই দেখছে শাসক শিবির। জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘সাগরদিঘি একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা। ওখানে বাইরন তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাবে জিতেছিলেন। সেটাকে সার্বিক করে দেখা ঠিক হবে না। তবে ঠিক কী হবে, তা স্পষ্ট হতে হতে মঙ্গলবার রাত কাবার হয়ে যেতে পারে!’’