Panchayat Election 2023

‘প্রতিরোধ’-এর তত্ত্বে মার খাচ্ছে শাসকই! লোকসভা ভোটের আগে কি তৃণমূলের কাছে ‘অশনি সঙ্কেত’?

বিরোধীরা সেই সব জায়গাতেই পাল্টা মারতে পেরেছে, যেখানে তারা ‘শক্তিশালী’। প্রতিটি জায়গাতেই তারা ‘গণপ্রতিরোধ’-এর তত্ত্ব দিয়েছে। বক্তব্য, তৃণমূল বুথ লুট করতে আসায় পাল্টা মার খেয়েছে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩ ১৮:০১
Many TMC workers died during Panchayat Election on Saturday

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্ব শুরুর দিন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম তাঁর ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট করেছিলেন। তাতে দেখা গিয়েছিল, খেঁটে লাঠির মাথায় লাগানো লালঝান্ডা। ছবির ক্যাপশনে সেলিম লিখেছিলেন— ‘প্রস্তুতি।’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী খোলাখুলিই বলেছিলেন, ‘‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই!’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দলীয় সমাবেশে বলেছিলেন, ‘‘তৃণমূলের কেউ মারতে এলে তারা যেন তাদের পিঠে লাঠির ছাপ নিয়ে ফিরে যায়!’’

শনিবারের পঞ্চায়েত ভোটে সেই ছবিই দেখা গেল ফলিত স্তরে। মনে করা হয়েছিল, শাসকদলের ‘মাতব্বরি’ হবে একপেশে। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের ময়দানে দেখা গেল, বহু জায়গায় পাল্টা মার খেয়ে পিছু হটেছে শাসক তৃণমূল। বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটে শনিবার বিকেল পর্যন্ত মৃত্যুর খতিয়ানে তৃণমূলই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দুপুরের মধ্যে শাসকদলের মোট আট জন প্রাণ হারিয়েছেন। রাজ্যের অন্তত দু’টি এলাকায় তৃণমূলের লোককে ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে প্রকাশ্যে পেটানো হয়েছে। যা সাম্প্রতিক অতীতে অভাবনীয়! তাদের কর্মী খুনের ঘটনাকে সামনে রেখে তৃণমূল অবশ্য বলার চেষ্টা করছে, তাদের লোকদের ‘টার্গেট’ করে করে খুন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, তারা ‘ভিক্টিম কার্ড’ হাতে নিয়ে নেমেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তাদের এই প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে যে, শাসকদল হিসেবে তারা নিজেদের লোকদেরও নিরাপত্তা দিতে পারছে না কেন!

Advertisement

তার চেয়েও বড় ‘রাজনৈতিক’ প্রশ্ন— বিরোধীরা যে ‘পাল্টা মারের রাস্তা নিয়েছে, আগামী বছর লোকসভা ভোটে কি তার কোনও প্রভাব পড়বে? তবে পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, বিরোধীরা সেই সব জায়গাতেই পাল্টা মার মারতে পেরেছে, যেখানে তারা সাংগঠনিক দিক দিয়ে ‘শক্তিশালী’। প্রতিটি জায়গাতেই অবশ্য বিরোধীরা ‘গণপ্রতিরোধ’-এর তত্ত্ব দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, তৃণমূল বুথ লুট করতে এসেছিল। তখন তারা পাল্টা মার খেয়েছে।

পাশাপাশিই বহু জায়গায় দেখা গিয়েছে, দলমতনির্বিশেষে মানুষ শাসকদলের বিরুদ্ধে তেড়ে গিয়েছেন। মোটরবাইক কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন। লাথি মেরে ব্যালট বাক্স নর্দমায় বা পুকুরে ফেলছেন। তাঁদের রোষের কারণ একটাই— তাঁদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি! সেই জনতায় সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি ভেদাভেদ করা যায়নি। সকলেই মিলেমিশে একাকার হয়ে সেই ‘প্রতিরোধ’-এ শামিল হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস বলে, শাসকদলের লোকেরা যখন বিরোধীদের হাতে মার খায়, তখন বুঝতে হয়, রাজ্যের রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই পিছনে তাকিয়ে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের কথা বলছেন। যে ভোটে পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ জিতেছিল তৃণমূল। সেই থেকেই তাদের উত্থান শুরু। সেই পঞ্চায়েত ভোটের পরের বছর লোকসভা ভোটে ধস নেমেছিল বামেদের। তার পর পর্যায়ক্রমে ২০১১ সালের ‘পরিবর্তন’। কিন্তু ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটেই প্রথম বোঝা গিয়েছিল, সিপিএম ‘অপরাজেয়’ নয়। বা সিপিএমকেও পাল্টা মার দেওয়া যায়।

তবে ১৫ বছর আগের পরিস্থিতি দিয়ে এখনকার পরিস্থিতি বিচার করা যাবে কি না, সে প্রশ্নও রয়েছে। কারণ, ১৫ বছর আগে বিরোধীদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। যিনি তাঁর নিজস্ব আন্দোলনের সঙ্গে গণ আন্দোলনকে জুড়ে একটা সার্বিক সিপিএম-বিরোধী রূপ দিতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয়ত, মমতা সেই সময় কংগ্রেসকেও পাশে পেয়েছিলেন। তাঁর নিজস্ব সিপিএম-বিরোধিতার বিষয়টি যেমন প্রশ্নাতীত ছিল, তেমনই ছিল কংগ্রেসের মতো একটি সর্বভারতীয় দলের প্রত্যক্ষ সহায়তাও। ফলে বামবিরোধী ভোট এককাট্টা করা গিয়েছিল। কিন্তু মমতার বিরোধিতা যারা করছে, সেই কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি দলীয় নীতি এবং বাধ্যবাধকতার কারণে কখনওই লোকসভা বা বিধানসভার ভোটে একজোট হতে পারবে না। কিন্তু শনিবারের ভোটচিত্র বলছে, অদূর ভবিষ্যতে বিরোধীরা তাদের শক্তিবৃদ্ধি করতে পারে। লোকসভা ভোটে যা তৃণমূলের পক্ষে অশনি সঙ্কেত হয়ে দেখা দিতে পারে। বাম-কংগ্রেস থেকে যে ভোট চলে গিয়েছিল, তা এর পরে ফিরে আসবে নাকি সেটাই দেখার।

শনিবার যে জেলাগুলিতে মার খেয়েছে তৃণমূল, তার মধ্যে রয়েছে মুর্শিদাবাদ এবং মালদহ। যে দু’টি জেলা ঐতিহ্যগত ভাবেই কংগ্রেসের ‘শক্ত ঘাঁটি’ বলে পরিচিত। নদিয়ায় ইদানীং বিজেপির উত্থান হলেও একটা সময়ে সেখানেও কংগ্রেসেরই রমরমা ছিল। যেমন গ্রামীণ বর্ধমানে দাপট ছিল সিপিএমের। অনুব্রত মণ্ডলের অনুপস্থিতিতে দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম এবং হুগলিতে যেমন বিজেপি ভোটের ময়দানে শাসককে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তেমনই উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে বিজেপি ‘মারমুখী’ হয়েছে।

পঞ্চায়েত ভোটের দুপুর পর্যন্ত তৃণমূলের যে আট জন নিহত হয়েছেন, তাঁদের হত্যায় মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর দিনাজপুরে অভিযুক্ত কংগ্রেস। আবার পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় তৃণমূল কর্মীকে খুনের অভিযোগ উঠেছে সিপিএমের বিরুদ্ধে। মুর্শিদাবাদের খুন হন দুই তৃণমূল কর্মী। নদিয়ার চাপড়ায় দলবল নিয়ে ভোট দিতে যাওয়ার সময়ে কুপিয়ে খুন করা হয় এক তৃণমূল কর্মীকে।

ভোটের দিন শাসকদলের এত কর্মী খুন হওয়ার প্রসঙ্গে তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘বিরোধীরা যে হিংসার অভিযোগ তুলছে, তা আসলে নাটক! সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে তৃণমূলের। আমাদের কর্মীদেরই খুন করা হচ্ছে। আমরা সরকারে আছি। তাই দায়িত্বশীল দল হিসাবে সব জায়গায় বলছি, প্ররোচনায় পা দেবেন না।’’

যা শুনে অনেকেরই অতীতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বাম জমানার শেষ পর্বে যখন জঙ্গলমহলে একের পর এক সিপিএম কর্মী খুন হচ্ছিলেন, তখন বাম নেতারা তৃণমূল-মাওবাদী আঁতাতের তত্ত্বের কথা বলতেন। বামফ্রন্টের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিমান বসু দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলতেন, ‘‘প্ররোচনায় পা দেবেন না। দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুন।’’ তখনও প্রশ্ন উঠত, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেন নিজের দলের লোকেদেরই নিরাপত্তা দিতে পারছেন না?

বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা-খুনোখুনির ইতিহাস দীর্ঘ। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট সেই নিরিখে কার্যত ‘মাইলফলক’ হয়ে আছে। সে বার ভোটের দিনই ৩০ জনের বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। শুধু মুর্শিদাবাদের ডোমকলেই প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ১৫ জন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেও ভোটে হিংসার ‘ঐতিহ্য’ বজায় থেকেছে। কোথাও কোথাও শাসকদলের ‘সন্ত্রাস’ বল্গাহীনও হয়েছে বলে দাবি বিরোধীদের। কিন্তু গত দু'টি পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিল, বিরোধী পক্ষের লোকেরা প্রাণ হারিয়েছেন। এ বার সেই ছবি খানিকটা উল্টে গেল! আরও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’, কোথাও কুপিয়ে আবার কোথাও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তৃণমূল কর্মীদের। যার অর্থ, তাঁদের ঘিরে ধরে মারা হয়েছে। যে সূত্রে এই প্রশ্নও উঠছে যে, মারমুখী বিরোধীদের চক্রব্যূহ থেকে বার করে নিয়ে যাওয়ার লোকও কি শাসকদলের ছিল না? না কি বিরোধীদের ‘জোটবদ্ধ প্রতিরোধ’-এর সামনে শাসকদলের কর্মীরা এঁটে ওঠেননি!

তেমন সত্যিই হয়ে থাকলে তা তৃণমূলের পক্ষে খুব ‘স্বস্তি’র বার্তা বহন করে না। আবার পাশাপাশিই, এই অভিজ্ঞতা শাসকদলের কাছে ‘বিপদসঙ্কেত’ হয়েও বাজতে পারে। আগামী এক বছরে ঘর গুছিয়ে নেওয়ার জন্য।

আরও পড়ুন
Advertisement