এবিপি গোষ্ঠী আয়োজিত ইনফোকম অনুষ্ঠানের মঞ্চে অভিলাষ টমি। শুক্রবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের সব চেয়ে দূরবর্তী স্থানে সামুদ্রিক ঝড়ের ধাক্কায় যখন ছোট্ট ডিঙি প্রায় উল্টে যাচ্ছে, তখনই ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনা। জলের তোড়ে মাস্তুল থেকে ঝুলতে থাকেন ক্যাপ্টেন তথা ডিঙির একমাত্র আরোহী। এর পরেই ধড়াম করে পড়েন নীচে, ডিঙির ডেকের উপরে। বারকয়েক সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, মারাত্মক রকমের চোট পেয়েছেন। সাড়ে তিন দিনের দীর্ঘ অপেক্ষার পরে এসেছিল সাহায্য। ‘গোল্ডেন গ্লোব রেস’-এ ছোট্ট ডিঙি নিয়ে একাকী বিশ্ব পরিক্রমা করতে গিয়ে ২০১৮ সালে এ ভাবেই প্রায় পঙ্গু হতে বসেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় নৌসেনার পাইলট অভিলাষ টমি।
তবে, হাল ছাড়েননি। মেরুদণ্ডে দু’টি টাইটেনিয়াম রডও তাঁর অদম্য জেদকে টলাতে পারেনি। হারাতে পারেনি তাঁর অনমনীয় মানসিকতাকে। ফলে, ২০২২ সালে অভিলাষ ফের অংশ নেন সেই ‘গোল্ডেন গ্লোব রেস’-এ, এবং দ্বিতীয় হন। এবিপি গোষ্ঠী আয়োজিত, তিন দিনের ইনফোকমের অনুষ্ঠানে এসে সমুদ্রে তাঁর জীবন-সংগ্রামের সেই মরণপণ কাহিনিই শুক্রবার শুনিয়ে গেলেন অধুনা আবুধাবি নিবাসী, কেরলের বছর পঁয়তাল্লিশের এই ‘নাবিক’।
সম্পূর্ণ একা, কোনও রকম আধুনিক প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সাহায্য ছাড়াই নৌকায় বিশ্ব পরিক্রমা করার প্রতিযোগিতাই খ্যাত ‘গোল্ডেন গ্লোব রেস’ নামে। একমাত্র কম্পাস ছাড়া জিপিএস, স্যাটেলাইট ফোন, ইন্টারনেট, অন্য কারও থেকে কোনও রকম সাহায্য বা যোগাযোগ— সব কিছুই এতে ‘নিষিদ্ধ’। সারা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত একশো জনেরও কম মানুষ এই দৌড়ে অংশ নিয়েছেন। অভিলাষ হলেন ৭৯তম। অর্থাৎ, পর্বতারোহণ বা মহাকাশ অভিযানের চেয়েও ঢের বেশি কঠিন ও বিপদসঙ্কুল এই সামুদ্রিক একাকী অভিযান।
১৯৬৮ সালে প্রথম এই দৌড়ের আয়োজন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বার আয়োজিত হয় ২০১৮ সালে, ঠিক ৫০ বছর পরে। সেই সময়ে ভারতে তৈরি ‘সুহেলি’ নামের ডিঙি নিয়ে জলে ভেসে পড়েন প্রথম এশীয় হিসাবে অংশ নেওয়া অভিলাষ। কিন্তু ৮২ দিন পরে, দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে ঘটে গিয়েছিল সেই দুর্ঘটনা। অভিলাষের এসওএস পেয়ে শুরু হয় বহুজাতিক উদ্ধারকাজ। সাড়ে তিন দিন পরে অবশেষে তাঁকে ভাঙা ডিঙি থেকে উদ্ধার করে একটি ফরাসি মাছ ধরার নৌকা। ১৮ দিন পরে নয়াদিল্লিতে মেরুদণ্ডে বসে টাইটেনিয়াম রড।
কী ভাবে কেটেছিল ওই সাড়ে তিন দিন? অনুষ্ঠানের পরে অভিলাষ বলেন, ‘‘ধ্যান আর নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকেই মনোযোগ দিয়েছিলাম। অযথা আতঙ্কিত হইনি। আহত হলেও মানসিক ভাবে দৃঢ় ছিলাম, খুশি ছিলাম। সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। তাই, যদি সাহায্য তাড়াতাড়ি না-ও আসত, তা হলেও অসুবিধা ছিল না।’’ কিন্তু এমন কঠিন পরিস্থিতিতে খুশি থাকা কী ভাবে সম্ভব? ‘‘পরিস্থিতিকে মেনে নিতে হবে। কী হতে পারে বা পারত, তা নিয়ে না ভেবে বর্তমানকে মেনে নিতে পারলেই মানসিক ভাবে ভাল থাকা সম্ভব। আমিও সেটাই করেছি।’’— অকপট অভিলাষ।
অনমনীয় এই নাবিকের সামনে ক্ষুদ্র প্রতিভাত হয়েছে জীবন। সুস্থ হয়ে, স্পনসর জোগাড়ের যুদ্ধ জয় করে ২০২২ সালে নৌকা নিয়ে ফের নেমেছেন প্রতিযোগিতায়। বাধা এসেছে সে বারেও। অপ্রতুল পানীয় জল, সামুদ্রিক ঝড়, নৌকার
অটো-পাইলট খারাপ হওয়া, খাদ্যসঙ্কট— সব বাধা পেরিয়ে ২৩৬ দিন পরে পৌঁছেছেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে, দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হিসাবে (২০২৩ সাল)।
এ ভাবে মাসের পর মাস সমুদ্রে একাকী জীবন কতটা কঠিন? অভিলাষের কথায়, ‘‘সেই সব দিনে নিজের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ
করা জরুরি। ধ্যান আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। জীবনে ভয় পাওয়াটাও দরকার, তবে সঠিক, পরিমিত পরিমাণে। আনন্দ, চিন্তা, ভয়, সব ধরনের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ধ্যান করেছি।’’
তবে একাকী যাপনের দিনে আপাতত বিরতি। যদিও মন পড়ে সেই সমুদ্রেই। বাড়িতে রয়েছেন বাঙালি স্ত্রী ও পাঁচ বছরের শিশুপুত্র। পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা, পুরস্কার। নিজের জল-যাপনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে ইসরো-র ‘গগনযান’ অভিযানে সাহায্য করছেন অভিলাষ। মহাকাশচারীদের প্রত্যাবর্তনের সময়ে সমুদ্রে আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে কী ভাবে, তারই পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। দুই মহিলা নৌসেনা অফিসারকে তাঁদের বিশ্ব পরিক্রমা অভিযানের আগে ‘মেন্টর’ করেছেন। ভারতীয় নৌসেনার উদ্যোগে গত অক্টোবরে ওই দুই অফিসার একযোগে পাড়ি দিয়েছেন সমুদ্রপথে। অভিলাষের মতে, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে পরিকাঠামো, উদ্ধারকাজ-সহ বিভিন্ন দিক আরও উন্নত করার বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
‘‘সাত হাজার কিলোমিটার উপকূল এলাকা আছে আমাদের, যেখানে সমুদ্রের জল গরম। এই সুবিধা অনেক দেশেই নেই। জলে ভেসে পড়ার এই খেলায় কোনও ম্যাচ ফিক্সিং নেই, ভক্তদের মারামারি নেই। তাই চরিত্র গঠনের জন্য প্রতিটি ভারতীয় শিশুকেই অন্তত এক বার সামুদ্রিক অভিযানে পাঠানো উচিত। এমনটা হলে, এক প্রজন্ম পরে আমাদের দেশটাই পাল্টে যাবে।’’ —বলছেন অভিলাষ।