ভিড়ে ঠাসাঠাসি। ছবি: উজ্জ্বল চক্রবর্তী।
দুপুর ২ টো ৫৭। দক্ষিণেশ্বর॥
মা দুগ্গার বাহন যেমন সিংহ, তেমন দুগ্গা দেখতে যাঁরা বেরোন, তাঁদের ভরসার বাহন এখন কলকাতা মেট্রো। দক্ষিণেশ্বর থেকে সুদূর দক্ষিণ— সব পুজোই যেন মেট্রো-সুতোয় বাঁধা। পুজোয় সেই মেট্রোর ভিড় দেখতেই বেরিয়েছি। দেখতে ঠিক নয়, ভিড় বুঝতে।
দুপুরের দক্ষিণেশ্বর স্টেশনে ছড়িয়েছিটিয়ে বড় জোর জনা পঞ্চাশেক। সকলেই পরিপাটি। সাজগোজ কারও বেশি। কারও বা একটু ম্যাট। ওই হালকা ভিড়েই এসি মেট্রোয় বসে ছাই রঙের তসর শাড়ি পরা সুরভি দত্ত। সঙ্গে বছর পনেরোর মেয়ে শ্রীজিতা। ষষ্ঠীতেই ‘শ্রীভূমি’র ঠাকুর দেখে নিয়েছেন। তালিকায় তেমন কিছু নেই। সপ্তমীর দুপুরে বন্ধুর বাড়িতেই আড্ডা দিয়ে কাটাবেন পেশায় স্কুল শিক্ষিকা সুরভি। থাকেন দক্ষিণেশ্বরে। নামবেন বেলগাছিয়া। অন্য যাদের সঙ্গে দেখা হল, তাঁরা সকলেই সপ্তমীর দুপুরে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছেন। গন্তব্য মোটামুটি এক। শুরুতে শোভাবাজার। তার পর বাগবাজার। বাকিটা রাস্তায় দেখা যাবে।
বরাহনগর॥
এসি কামরায় আরও জনা কয়েক যাত্রী উঠলেন। ফাঁকা দেখে ছুটোছুটি করে বসে পড়ল বছর আঠারোর পাঁচ জন। জাম্পস্যুট পরে দুই কিশোরী। জিনস-টিশার্টে দুই কিশোর। পঞ্চম জনের পাঞ্জাবি। কোঁকড়া চুল। নাম জানলাম, আকাশ চৌধুরী। বাকিদের মতো টিশার্ট নয় কেন? জবাব এল, ‘‘বাড়িতে পুজো হয়। অষ্টমীতে বেরোনোর অনুমতি নেই যে। তাই আজই পাঞ্জাবিটা পরে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। আজই আমার অষ্টমী।’’ মুখটা কি একটু ফ্যাকাশে লাগল! পাঁচ জনেরই গন্তব্য ম্যাডক্স স্কোয়্যার। ওরা নামবে যতীন দাস পার্ক। দুপুর দুপুর গিয়ে জায়গা দখলই উদ্দেশ্য আকাশদের।
নোয়াপাড়া॥
জনা চারেক যাত্রী উঠলেন। উদ্দেশ্য-বিধেয় কোনওটার সঙ্গে পুজোর কোনও যোগ আছে বলে মনে হল না। প্রবীণা কেতকী ঘোষ নামবেন রবীন্দ্র সদনে। এসএসকেএমে এক আত্মীয় ভর্তি। তাঁকে দেখতে যাবেন।
দমদম॥
মেট্রো ঢুকছে। মনে হচ্ছে জনসমুদ্রে সাঁতার কেটে ঢুকছে রেকটা। কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। আলতো গতিতে বাইরে চোখ চালালে দেখা যায়, পোশাকের ‘বেনিআসহকলা’। দরজা খুলতেই ‘রেডি স্টেডি গো’। উঠেই যেন মিউজিক্যাল চেয়ার! মেট্রো পুরো টইটম্বুর! উঠতে পারলেও জায়গা পেলেন না বছর চল্লিশের প্রতিমা সেন আর তাঁর ১১ বছরের মেয়ে। নাগেরবাজারে থাকেন। সবুজ-জরি পাড় শাড়ি। গলায় ঝলমলে পাথরের হার। ঠাকুর দেখতে যাচ্ছেন? কোথায় কোথায় ঘুরবেন? একটু কিন্তু কিন্তু প্রথমটার উত্তর দিলেন, ‘‘হ্যাঁ।’’ পরের প্রশ্নটা যেন এড়িয়ে গেলেন। আচমকা অপিরিচিতের প্রশ্নে একটু অস্বস্তিতেই। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বললেন, ‘‘আমি আর মেয়ে রাস্তা কিছুই চিনি না। ছেলে যেখানে নিয়ে যাবে, যাব। উত্তর দিয়ে বোধ হয় শুরু করবে।’’ পাশে বছর আঠারোর ছেলে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘‘মা, সেন্ট্রাল নামব।’’ তার পর এ দিকে তাকিয়ে, ‘‘মহম্মদ আলি পার্কের ঠাকুর দেখে দক্ষিণ।’’
বেলগাছিয়া॥
জনা দুই নামলেন। ওঠার চেষ্টায় ঝাঁকে ঝাঁকে। এই ভিড়ে আর উঠবেন কোথায়! তবুও ধাক্কাধাক্কি করে উঠলেন ঝকঝকে কৈশোর পেরোনো তিন তরুণ। শহরেরই এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। এক জন ছয়, বাকি দু’জন মেরেকেটে সাড়ে পাঁচ। ছয় ফিটের তরুণ আর্যব জানালেন পার্ক স্ট্রিটে নামবেন। পুজোর দিনে পার্ক স্ট্রিট? একটুও না থমকে আর্যব বলেন, ‘‘অলি পাব যাব। একটু পানাহার। তার পর ঘুরব। ঠাকুর দেখব।’’ বাকি দু’জন মুখ টিপে হেসে নিলেন। তার মধ্যেই বেঁটে-লম্বা নিয়ে একটা মাঝারি তর্ক। মজাদার সে তর্কে মিশে থাকে কিছু অশালীন শব্দও। ভিড়ের গুঞ্জনে সেই তর্ক কখন যেন মিলিয়েও যায়। খুলে যায় দরজা।
শ্যামবাজার॥
ভিড় ছেনে উঠলেন মধ্য চল্লিশের এক বধূ। জায়গা তো নেই। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করলেন। পূরবী সামন্ত যেখানটায় দাঁড়িয়ে, তার ঠিক পাশেই বসার আসন শুরু হয়েছে। ভিড়ের ফাঁক দিয়েই স্পষ্ট শোনা গেল, ফোনে বলছেন, ‘‘এই বাবাকে বল, মেট্রোয় উঠে গিয়েছি। কালীঘাট নামব।’’ একটু এ দিকে সরে আসতেই জানতে চাইলাম, ঠাকুর দেখতে যাচ্ছেন? জবাব এল, ‘‘নাহ্, সারা বছর খেটেখুটে আর ও সব ভাল লাগে না।’’ বছরে পুজোর একটা দিন কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেন। এক বন্ধুর বাড়ি পুজো হয়। সেখানে বসে আড্ডা দেন। খাওয়াদাওয়া করেন।’’
শোভাবাজার॥
এখানেই তো খালি হওয়ার কথা ছিল! কিন্তু তা তো হলই না, বরং ৪ গুণ ভরে গেল কামরা। যাঁরা উঠলেন, শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর দেখে এখন ‘পুণ্যার্থী’। মুখে বিজয়ীর হাসি। উঠলেন এক নবদম্পতি। তরুণীর গায়ে নীল রঙের বালুচরী। হাতে শাখা-বালা। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে তরুণের নীল কুর্তা-জিনস। মেট্রো একটু দুলে উঠল। ভিড়ের চাপে নাজেহাল ওরাও দুললেন। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে ছিটকেও গেলেন তৎক্ষণাৎ। আমার পাশের আসনের তরুণী নামবেন বলে উঠতেই, স্ত্রীকে ঠেলে দিলেন তরুণ। ছুটে এসে বসে পড়েন বছর বাইশের পৌলমী। থাকেন কালীঘাটের শরৎ বোস রোড পোস্ট অফিসের কাছে। ‘‘শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর দেখতে গেছিলাম। ওটা দিয়েই পুজো শুরু। এ বার এক এক করে সব ঠাকুর দেখব। চেতলা দেখব। বাদামতলা দেখব,’’— বলেই মোবাইলে মন। সিরিয়াল চালিয়ে দিলেন। কানে ইয়ারফোন।
গিরিশ পার্ক॥
জনা দশেকের সঙ্গে সাত বছরের মেয়ের হাত ধরে উঠে পড়েন হলুদ জামদানি পরা এক মা। দু’জনের ঠোঁটেই গোলাপি লিপস্টিক। মেয়েকে নিয়ে লিপিকা যাচ্ছেন সাউথ সিটি মলে। নামবেন রবীন্দ্র সরোবর। লিপিকার কথায়, ‘‘সাউথ সিটিতে মেয়ের স্কুলের বন্ধু আর তাদের মায়েরা আসবে। ফুডকোর্টে খাওয়াদাওয়া করব। আড্ডা দেব। বাচ্চাগুলো একটু গল্পগুজব করবে। ওদের গল্প মানে তো ঝগড়া। ওই আমাদের মায়েদের তাগিদেই আড্ডা।’’
মহাত্মা গান্ধী রোড॥
ভিড়ের সঙ্গে উঠে পড়ে বিতান, অভিজিৎ, আকাশ আর রাহুল। সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যার, মহম্মদ আলি পার্ক দেখে এ বার দক্ষিণের পথে। চার জনই পড়ে দশম শ্রেণিতে। থাকে বেহালায়। সকালে বাসে চেপে এসেছে। এ বার মেট্রোয় কালীঘাট। পদবি জিজ্ঞেস করায় বেশ বিপাকে বিতান। বলে, ‘‘বলতেই হবে?’’ তার পরই গল্পে মশুগুল চার জন।
সেন্ট্রাল॥
গল গল করে নেমে যায় উত্তরের ভিড়। তার পরেই প্রশ্ন ভেসে আসে, ‘‘এটায় উঠলে চেতলা অগ্রণী?’’ বাসের মতো হেঁকে যাওয়ার জন্য এক জন কন্ডাক্টর থাকলে বোধ হয় ভাল হত। পাশে জায়গা খালি হতেই ছুটে এসে বসে পড়েন দেবাঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরনে নীল স্কার্ট আর টপ। বাড়ি কুঁদঘাট। দুই মেয়ে আর বোনকে নিয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর দেখতে এসেছিলেন। ফেরার পথে কালীঘাট নামবেন। দেবাঞ্জনা বলেন, ‘‘জানেন, ষষ্ঠীর দিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। মাত্র তিনটে ঠাকুর দেখেছি। তাই আজ মেট্রোয়। অনেক ঠাকুর দেখব।’’
চাঁদনি চক॥
নামা-ওঠা চোখে পড়ার মতো নয়।
এসপ্ল্যানেড॥
আবারও ভিড়। আবারও ধাক্কাধাক্কি। তার মাঝেই কারও কারও গলায় তীব্র বিরক্তি। বলে চলেছেন, ‘‘এই মাঝে মধ্যে সব মেট্রোয় ওঠে। কী জ্বালা রে বাবা! ঠিক করে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না।’’ ভিড় ঠেলে উঠে পড়েন দুই যুবক। সঙ্গে এক কিশোর। ভিড়ের কারণে কথাই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু বার বার চোখ চলে যাচ্ছে ওই কিশোরের দিকে। কী অবাক ভাবে দেখছে সবাইকে! মেট্রো, তার যাত্রী, তাঁদের পোশাক! বছর দশেকের ওই ছেলেটিকে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল অপুর কথা। অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। দু’-এক জনকে পাশ কাটিয়ে প্রশ্নটা ছুড়লাম, কী নাম? জবাব এল, ‘‘কিশোর।’’ একটু ওড়িয়া টান যেন! কোথায় থাকা হয়? টানটা শুনে প্রশ্নটা হিন্দিতেই করলাম। জানলাম, ওড়িশার বারিপদায় বাড়ি। পুজো দেখতে এসেছে কাকার সঙ্গে। সঙ্গে কাকার এক বন্ধু। ভাঙা ভাঙা বাংলা, হিন্দি মিশিয়ে কাকা অভিজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা বাঙালি। বহু প্রজন্ম ধরে ওড়িশায়। ওড়িয়াতেই কথা বলি। ভাই এখন বনহুগলির মেসে থেকে চাকরি করেন। পুজো দেখতে চলে এসেছি।’’ প্রথম গন্তব্য সুরুচি সংঘ।
পার্ক স্ট্রিট॥
ভিড়ের হ্রাস-বৃদ্ধি কিছুই হল না। শুধু নেমে গেলেন অলি পাবে যেতে চাওয়া তরুণেরা।
রবীন্দ্র সদন॥
হাসপাতালে আত্মীয়কে দেখতে যাওয়া কেতকী কি নামতে পারলেন? দেখতে পেলাম না।
নেতাজি ভবন॥
মিনি স্কার্ট পরা এক তরুণী আর সাদা শার্ট-খাকি ট্রাউজার পরা তরুণ পাশ থেকে নেমে গেলেন। ফোরামে যাবেন। ইটালিয়ান খাবেন সপ্তমীতে। নাম-ধাম জানা হল না যে!
যতীন দাস পার্ক॥
কামরায় একটা চাপা উত্তেজনা— ‘‘ম্যাডক্স স্কোয়্যার এসে গেছে!’’ মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই খোলা মাঠটা কি দেখা যায়! নামতে চাওয়া ভিড়ের অনেকেই তা জানেন না।
কালীঘাট॥
অনেক ক্ষণ পর মেট্রোর দু’দিকের জানলার বাইরেটা যেন একটু দেখা গেল। ইতস্তত করেও মেট্রোয় শেষমেশ উঠে পড়েছেন বছর চল্লিশের এক যুবক। সঙ্গে স্ত্রী আর দুই সন্তান। ছোট ছেলেটির বয়স বছর দশেক। নাম জয় গারুর। জানলাম, মইপিঠে থাকেন। সুন্দরবনের বৈকুণ্ঠপুর। সেখান থেকে নৌকায় চেপে, তার পর হেঁটে এসেছেন মথুরাপুর। স্টেশন থেকে ক্যানিং লোকাল ধরে নেমেছেন বাঘাযতীন। তার পর মেট্রোয় চড়ে কালীঘাট মন্দির। এ বার যেতে চান দক্ষিণেশ্বর। কিন্তু উল্টো দিকের মেট্রোয় উঠে পড়েছেন তো! শুনে ভয় পেয়ে গেলেন জয়ের বাবা। তবে পরের স্টেশনে নেমে অন্য দিকে ট্রেন উঠলেই চলবে বলায় স্বস্তি পেলেন। ওঁর স্ত্রীর নাম দুর্গা। একটু ধীরস্থির। বললেন, ‘‘দক্ষিণেশ্বরে মন্দির দর্শন করে এক এক করে ঠাকুর দেখব। সারা রাত। কাল সকালে বাঘাযতীনে পিসির বাড়ি ফিরব। দুপুরে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরব।’’
রবীন্দ্র সরোবর॥
জয়দের সঙ্গে নেমে গেলেন আর এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। জানিয়ে গেলেন, মুদিয়ালি, শিবমন্দির দেখে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে খানাপিনা করবেন। রাতে মেট্রো ধরে বাড়ি। থাকেন ডানলপে।
মহানায়ক উত্তর কুমার॥
টালিগঞ্জেও ভিড় নেই। সব ভিড় যেন উত্তর আর মধ্যে।
এর পর নেতাজি। মাস্টারদা সূর্য সেন। গীতাঞ্জলি। কবি নজরুল। শহিদ ক্ষুদিরাম। ছবিটা একই। রোজের কাজে উঠলেন জনা কয়েক। নামলেনও তা-ই।
কবি সুভাষ॥
কামরার শেষ যাত্রী সুমিতা ঘোষ। থাকেন নিউ গড়িয়া। বছর বাইশের তরুণী সকালে ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়েছিলেন রাসবিহারী চত্বরের ঠাকুর দেখতে। এখন আবার বাড়ি ফিরে দুপুরের খাওয়া সারবেন। তার পর আবার বেরোবেন সন্ধ্যায়। এত এনার্জি কী ভাবে? এক চিলতে হাসি ঠোঁটে জড়িয়ে বললেন, ‘‘সন্ধ্যায় ভাবছি শ্রীভূমি যাব। দেখি পারি কি না! খুব ভিড় হচ্ছে তো! এনার্জি নিতেই তাই বাড়ি যাচ্ছি।’’ হাসিটা এ বার ছড়িয়ে গেল সারা মুখে।