স্লোগান আর জনসমুদ্রে আলিমুদ্দিন যেন মিনি ব্রিগেড

বেলা যত গড়িয়েছে, বাইরের লাইন তত লম্বা হয়েছে। শ্রদ্ধা জানাতে কেউ জেলা থেকে এসে সকাল সকাল লাইনে দাঁড়ালেন,কেউ আবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে একটি বার প্রিয় নেতাকে দেখার আশায়।

Advertisement
মিলন হালদার, চন্দন বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৪ ০৬:৩২
বিদায়: বিধানসভা থেকে আলিমুদ্দিনের পথে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেহ।

বিদায়: বিধানসভা থেকে আলিমুদ্দিনের পথে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দেহ। নিজস্ব চিত্র।

শেষ শ্রদ্ধা জানানোর লাইনটা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে এ জে সি বসু রোড ধরে চলে গিয়েছে কয়েকশো মিটার। সেই ভিড়ে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক যুবক। গলায় প্ল্যাকার্ড ঝোলানো। সাদা কাগজের উপরে লাল কালিতে লেখা, ‘শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। সেইপ্ল্যাকার্ড দেখিয়ে সৌরদীপ দে নামে ওই যুবক বললেন, ‘‘আমরা হয়তো ওঁকে বুঝতে দেরি করে ফেলেছিলাম। এখন আর আফশোস ছাড়া সম্বল কী আছে?’’

Advertisement

বেলেঘাটার বাসিন্দা সৌরদীপই শুধু নন। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে শেষ বারের মতো দেখতে শুক্রবার সকাল থেকে আলিমুদ্দিনের সামনে ভিড় করেছিলেন অগণিত বামকর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকেরা। বেলা যত গড়িয়েছে, বাইরের লাইন তত লম্বা হয়েছে। শ্রদ্ধা জানাতে কেউ জেলা থেকে এসে সকাল সকাল লাইনে দাঁড়ালেন,কেউ আবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে একটি বার প্রিয় নেতাকে দেখার আশায়। সেই ভিড়ে যেমন ছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তেমনই মালা হাতে ছিল স্কুলের পোশাক পরা পড়ুয়ারাও।

এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তপসিয়ার পিস ওয়ার্ল্ড থেকে শববাহী শকটে বার করা হয় বুদ্ধবাবুকে। প্রথমে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বিধানসভায়। সেখানে আধ ঘণ্টা রাখার পরে তাঁকে আনা হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের দলীয় কার্যালয়ে। বাম কর্মী-সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য এ দিন আলিমুদ্দিন স্ট্রিট নির্দিষ্ট করা হলেও বিধানসভার বাইরেও ভিড় জমিয়েছিলেন অনেকে। সেখানে বার বার ওঠে স্লোগান।

সকালে বিধানসভার ছ’নম্বর গেটের সামনে চলে এসেছিলেন সঞ্জীপ বড়ুয়া। হ্যান্ড মাইক হাতে তাঁকে স্লোগান দিতে শোনা গেল। সঞ্জীপ বলেন, ‘‘সারা জীবনের মতো মৃত্যুর পরেও উনি থেকে গেলেন। ওঁর দান করা চোখে অন্য মানুষ দৃষ্টি ফিরে পাবেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমি বামপন্থী নই। তবে, বুদ্ধবাবুর গুণমুগ্ধ। তাই না এসে পারিনি।’’

সঞ্জীপের মতো না এসে পারেননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর এমন অসংখ্য গুণমুগ্ধ। মূলত আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং দীনেশ মজুমদার ভবনে এ দিন সাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বুদ্ধবাবুর মরদেহ আলিমুদ্দিনে আসার বহু আগে থেকেই সেখানে ভিড় করতে শুরু করেছিলেন বাম কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ। দেহ আসার পরে বাইরের সেই ভিড়ই কার্যত মিনি-ব্রিগেডের চেহারা নেয়। এক সময়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে বেরোনো লাইন চলে যায় মৌলালি ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা দূর।

কলকাতায় শাখা সংগঠনের সম্মেলনে আসা ভিন্‌ রাজ্যের বামকর্মীদের চারশো জনের একটি দলকেও আলিমুদ্দিনে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা গিয়েছে এ দিন। ভুবনেশ্বরের বাসিন্দা সিপিএম নেত্রী পুষ্পা দাস এসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘বুদ্ধদা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নন, ভারতের মেহনতী মানুষের নেতা। তাঁদের আদর্শ।’’

রাস্তায় ভিড়ের লাইনে মায়ের সঙ্গে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল অম্বরীশ ভট্টাচার্য। ষষ্ঠ শ্রেণির ওই পডুয়াবলে, ‘‘ভেবেছিলাম, এক বার সামনে গিয়ে ফুলগুলো দেব। সেটা না পারলেও, এক বার চোখের দেখা পেলেই হবে। সেটাই সারা জীবন মনে থেকে যাবে।’’

বুদ্ধবাবুর শববাহী শকট দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে পৌঁছনো মাত্র সেখানে ভিড় করে থাকা সিপিএম নেতা-কর্মীরা স্লোগান তোলেন, ‘কমরেড, তোমায় ভুলছি না, ভুলব না’। তাতে গলা মেলায় উপস্থিত জনতা। যদিও ভিড়ের চাপে সেখানে বুদ্ধবাবুকে বেশি ক্ষণ রাখা যায়নি।

অনেকের মতে, মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে নিজেকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শেষযাত্রাতেও তার ব্যতিক্রম হল না। দিনভর সেই আবেগই যেন বার বার আছড়ে পড়ল বিধানসভাথেকে শুরু করে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হয়ে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত।

আরও পড়ুন
Advertisement