কৃষ্ণ সাঁতরা। —নিজস্ব চিত্র।
সকালে তখনও আমার ঘুম ভাঙেনি। হঠাৎ কানে এল চিৎকার-চেঁচামেচি। প্রথমে তেমন গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম, কেউ ঝগড়া করছে। বস্তিতে ছোটখাটো জিনিস নিয়ে যেমনটা হয়ে থাকে আর কী! কিছু ক্ষণ পরে হঠাৎই দেখি, ঘরের ভিতরে ধোঁয়া ঢুকছে। তখন বিষয়টা বুঝতে পেরে আর দেরি করিনি। কোনও মতে অসুস্থ মাকেও বাইরে বার করে আনতে পারি।
বস্তির আমাদের টিনের ছোট্ট ঘরে থাকি তিন জন। আমি, বাবা এবং কিডনির অসুখে ভোগা মা। বাবা ভোরে কাজে বেরিয়ে যায়। আমি আর মা বাড়িতে থাকি। এ দিনও বাবা ভোরে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পরে আবার ঘুমোনোয় একটু দেরি করেই আমি প্রতিদিন উঠি। এ দিনও তাই প্রতিবেশীদের অনেকের ঘুম ভাঙলেও আমার ভাঙেনি। এখন শুধু ভাবছি, ঘুমের ঘোরে আর একটু দেরি হলে আমাদের কী হত?
আমাদের ঘরের পাশেই তুলোর গুদামে প্রথমে আগুন লাগে। তুলো দাউদাউ করে জ্বলতে থাকায় আগুনের তাপ আমাদের ঘরের ভিতরেও বোঝা যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে ধোঁয়ায় ভরে যেতে থাকে ঘর। ধড়মড়িয়ে কোনও মতে উঠে যখন একটু সম্বিত ফেরে, তখন দেখি ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে। প্রথমে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু বাইরে এসে মাকে দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারি, মা তখনও ভিতরেই রয়ে গিয়েছে। কিছু না ভেবেই আবার ভিতরে ছুটে যাই মাকে বার করে আনতে। আগুন টপকে কোনও মতে ঘরের ভিতরে ঢুকে মাকে নিয়ে ফের বেরিয়ে আসি। তত ক্ষণে আমাদের ঘরের একাংশেও আগুন ধরে গিয়েছে। পিঠে আগুনের হলকা লাগে। তাতেই কিছুটা পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু মাকে বার করতে পারলেও ঘরটা চোখের সামনে দাউদাউ করে পুড়ে গেল। কিছুই করার ছিল না। দৌড়াদৌড়ি করে জল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এত বড় আগুন কি এক-দু’বালতি জলে নেভে?
দমকল এসে যত ক্ষণে আগুন নেভাল, তখন ঘরের কিছুই অবশিষ্ট নেই। চাল থেকে শুরু করে আনাজ, টাকা-পয়সা— সব পুড়ে ছাই। মায়ের চিকিৎসার কাগজপত্রও বার করতে পারিনি। আমার মায়ের দুটো কিডনিই প্রায় অকেজো। এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। মাকে প্রতিদিন অনেক ওষুধ, ইনজেকশন দিতে হয়। সব ঘরে রাখা ছিল। আমার কাগজপত্র, সার্টিফিকেটও পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। সদ্য একটা কাজ পেয়েছি আমি। আগামী সোমবার কসবার শপিং মলে একটা দোকানে কাজে যোগ দেওয়ার কথা। জানি না, ওই কাজটায় যোগ দিতে পারব কি না। প্রাণ তো বাঁচল। কিন্তু বাকি সব শেষ হয়ে গেল এক আগুনে।