মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় এবং মহম্মদ সেলিম। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাজ্য সিপিএম কি একক ভাবে একজনকে ‘মুখ’ করার লাইনে হাঁটছে? দলের যুব সংগঠনের সম্পাদক মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের ছবি-সম্বলিত প্রচার ঘিরে দলের মধ্যেই দুই মতের ‘দ্বন্দ্ব’ তৈরি হচ্ছে। নিচুতলায় পুরনো দিনের রক্ষণশীল নেতৃত্ব মিনাক্ষীর ছবি দিয়ে ইনসাফ যাত্রার প্রচারে বিরক্ত। আবার তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ সেই মতামতকে কার্যত গুরুত্বই দিচ্ছে না। তাদের কাছে মিনাক্ষী ‘ক্যাপ্টেন’।
এ হেন প্রেক্ষাপটে দলের অবস্থান স্পষ্ট করে দিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। আনন্দবাজার অনলাইনকে সেলিম বলেছেন, ‘‘ভেবেচিন্তেই ওঁকে (মিনাক্ষীকে) সামনে আনা হচ্ছে। ওঁকে যখন যুবর রাজ্য সম্পাদক করা হয়েছিল, তখন থেকেই এটা হচ্ছে। মানুষ যদি কাউকে মুখ করে নেন, তা হলে কার কী করার থাকতে পারে?’’ তবে পাশাপাশিই সেলিম বলেন, ‘‘একা মিনাক্ষী নন, তরুণ প্রজন্মের আরও অনেককেই সামনে আনা হচ্ছে।’’
এ কথা ঠিক যে, ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর সিপিএমের নেতৃত্বস্তরে প্রজন্মের ফাঁক কঙ্কালসার দশাকে বেআব্রু করে দিয়েছিল। দলের অনেকেই পার্টি কাঠামোকে ‘বৃদ্ধাশ্রম’ বলে কটাক্ষ করতেন। প্রসঙ্গত, তৃণমূলের মধ্যে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে সম্প্রতি শাসকদলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষও সিপিএমের প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, ‘‘নেতারা যদি দেহত্যাগ না করলে পদত্যাগ না করেন, তা হলে দলটা ক্রমশ সিপিএমের বৃদ্ধতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাবে!’’
একটি অবামপন্থী দলে একজনকে ‘মুখ’ করা যতটা সোজা, বামপন্থী দলে তা হয় না। কারণ, তাদের সাংগঠনিক কাঠামোয় তা নেই। সিপিএমের প্রবীণ কৃষক নেতা তথা পলিটব্যুরোর প্রাক্তন সদস্য হান্নান মোল্লা আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘ছবি দিয়ে প্রচার একটা নতুন ফ্যাশন, নতুন ট্রেন্ড। সময়ের সঙ্গে একে মেনে নিতে হবে। এর মধ্যে অন্যায় দেখি না।’’
তবে মিনাক্ষীকে ‘মুখ’ করার বিষয়টি যে এখনও সাংগঠনিক ভাবে নিচুতলায় সিপিএম পৌঁছে দেয়নি, তা স্পষ্ট। কারণ, ইনসাফ যাত্রাকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গায় ব্যক্তি মিনাক্ষীর ছবি-সম্বলিত ফ্লেক্স, হোর্ডিং দিয়ে প্রচার হচ্ছে। তাতে দলের একটি অংশ আপত্তি তুলছে। আবার সেই আপত্তি এড়িয়ে কৌশলে মিনাক্ষীর ছবি দিয়ে প্রচারও হচ্ছে। যেমন হুগলির বৈদ্যবাটি সরকারি আবাসনের বাসিন্দা সঞ্জয় ঘোষ একটি ছোট চায়ের দোকান চালান। ইনসাফ যাত্রা উপলক্ষে তিনি নিজের খরচায় একটি ২৪/৪ ফুট ফ্লেক্স দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন জিটি রোডের পাশে। মিনাক্ষীর ছবি সম্বলিত সেই ফ্লেক্সে লেখা ‘বাংলার ক্যাপ্টেন’। সূত্রের খবর, স্থানীয় স্তরের সিপিএম নেতাদের একাংশ আপত্তি জানিয়েছিলেন ওই প্রচারে। কিন্তু ব্যক্তি সঞ্জয় দলের কেউ না হওয়ায় কোনও সাংগঠনিক ‘হুইপ’ কাজ করেনি। সঞ্জয়ের কথায়, ‘‘মিনাক্ষী আমার কাছে আবেগ। অনেকদিন পর একজন নেত্রী পেয়েছি। সুতরাং ওই আবেগকে তত্ত্বকথা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এক জনকে মুখ করা প্রয়োজন। আমার মনে হয়, রাজ্যে বামপন্থীদের কাছে মিনাক্ষীর বিকল্প নেই।’’ উল্লেখ্য, গত ৩ নভেম্বর কোচবিহার থেকে শুরু হয়েছে সিপিএমের ইনসাফ যাত্রা। বৃহস্পতিবার তা ৪২ তম দিনে পড়ছে। যুবনেতারা জানাচ্ছেন, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, বাঁকুড়া-সহ বিভিন্ন জায়গায় মিনাক্ষীর ছবি-সম্বলিত কাট আউট দেখা গিয়েছে।
সিপিএমের মধ্যে যুবনেত্রী মিনাক্ষীকে নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে আবেগ কাজ করছে। জেলায় জেলায় তাঁকে দিয়ে সভা করানোর জন্য আলিমুদ্দিনে অনুরোধের দিস্তা দিস্তা চিঠি জমা পড়াও এখন আর নতুন ঘটনা নয়। তবে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব কুলটির শিল্পাঞ্চল থেকে উঠে আসা তরুণীকে মুখ করতে চাইছেন কোনও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নয়। তাঁরা চাইছেন গোটাটা হোক ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ভাবে। তবে সিপিএম যে ‘মুখ’ তৈরি করতে চাইছে তা স্পষ্ট। এত দিন নেতাদের এ নিয়ে প্রশ্ন করলে জবাব মিলত, ‘‘নেতা নয়, নীতির লড়াই।’’ সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে ‘নেতা’ বা ‘মুখ’ যে ফ্যাক্টর, তা অনেকে বুঝলেও বিষয়টি বামেদের বোঝার বাইরেই ছিল। কিন্তু সিপিএমের শীর্ষনেতৃত্ব স্পষ্ট করে দিলেন, আপ্তবাক্য না আউড়ে বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়াই শ্রেয়।