— প্রতীকী চিত্র।
২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর। রবিবারের সকাল। আচমকা গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছিল হাওড়ার আন্দুল রোডের তেঁতুলতলা। মোটরবাইকে আসা তিন দুষ্কৃতীর গুলিতে নিজের দোকানেই লুটিয়ে পড়েছিলেন সদ্য সিপিএম থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া, ব্যবসায়ী-প্রোমোটার কৃষ্ণপদ বর্ধন ওরফে কালা।
২০১২ সালের ২ অগস্ট। রাত ৯টা। শিশুকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোনো বাবু বাগচী নামে আর এক তৃণমূল নেতা তথা প্রোমোটারকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তাঁর বাড়ির সামনেই গুলি করে খুন করে মোটরবাইকে আসা
দুই যুবক।
২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর। বিকেল ৪টে। কলেজ রোড ফ্লাইওভারে পরপর ৬ রাউন্ড গুলি করে খুন করা হয় দক্ষিণ হাওড়ার যুব তৃণমূল নেতা তথা এলাকার ডাকসাইটে প্রোমোটার ধর্মেন্দ্র সিংহকে। আগের দু’টি খুনের মতোই মোটরবাইকে আসা তিন আততায়ী খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে ধর্মেন্দ্রকে খুন করে বলে পুলিশি তদন্তে জানা যায়।
২০০৯ থেকে ২০২০— দক্ষিণ হাওড়ায় এই তিনটি খুনের ঘটনা টলিয়ে দিয়েছিল শাসক দলের নেতাদের। কারণ, নিহতেরা সকলেই ছিলেন এলাকার তৃণমূল নেতা এবং পেশায় প্রোমোটার। এবং খুনের অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে উঠেছিল, তাঁরাও ছিলেন এলাকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা। সকলেই প্রোমোটিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ সূত্রে খবর, এর মধ্যে ২০০৯ সালে জমি, বাড়ি বিক্রি ও এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে তেঁতুলতলায় খুন হন কালা। তাঁকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় পরবর্তীকালে ধর্মেন্দ্রের সহযোগী হয়ে ওঠা দেবেন্দ্র ঠাকুরকে। তৃণমূল সূত্রে খবর, সেই দেবেন্দ্রই এখন বন্ধুপত্নীকে এলাকার কাউন্সিলর পদে প্রার্থী করার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।
২০১২ সালে শালিমার এলাকায় রানি রাসমণির লালকুঠির ৬৫ বিঘা জমি প্রোমোটিং-এর চেষ্টা করায় বাবু বাগচী খুন হন। তাঁকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এলাকার উঠতি যুব নেতা ধর্মেন্দ্র সিংহ, দেবেন্দ্র মিশ্র ও কিট্টু বসুকে। তিন জনই কয়েক বছর করে জেল খাটার পর জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকায় ফিরে আসেন।
জেল থেকে বেরিয়ে দেবেন্দ্র ধর্মেন্দ্রকে ছেড়ে শালিমারে চন্দন-ভিকির সিন্ডিকেটে নাম লেখান। ধর্মেন্দ্র বটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় ফিরে এক শাগরেদের সঙ্গে শুরু করেন প্রোমোটিং ও নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের একচেটিয়া ব্যবসা। তৈরি হয় শালিমারের সিন্ডিকেট দখলের লড়াই। কিন্তু লালকুঠির ৬৫ বিঘা জমিতে ২৫ তলা বহুতল আবাসনের নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ ধর্মেন্দ্র একা করতে চাইলে দু’পক্ষের গোলমাল চরমে ওঠে। বোমাবাজি, মারপিট নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় শালিমারে।
এরই মধ্যে ২০২০ সালের এক শীতের বিকেলে নৃশংসভাবে খুন হন ধর্মেন্দ্র। তাঁকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় বিরোধী গোষ্ঠীর তিন নেতা চন্দন চৌধুরী, দেবেন্দ্র মিশ্র ও বিকাশ সিংহ ওরফে ভিকিকে। ধৃতদের নামে পুলিশের খাতায় আগে থেকেই খুন, বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র রাখা ও মারপিটের অভিযোগ থাকায় এবং তারা ঘোষিত ধর্মেন্দ্র-বিরোধী হওয়ায় তদন্তকারীরা ধর্মেন্দ্র-হত্যা রহস্য সমাধানে বিন্দুমাত্র সময় নেননি। বিশেষ করে শালিমারের ৬৫ বিঘার জমি নিয়ে দু’পক্ষের গোলমাল চরমে ওঠায় এবং খুনের ঘটনার দিন তিন জনই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় পুলিশ তাদের ধর্মেন্দ্রকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করে। ধৃতেরা এখনও জেল হেফাজতে।
কিন্তু এই তিনটি খুনের ঘটনাকে ঘিরে যে হিন্দি ব্লকবাস্টার ছবি ‘গ্যাং অফ ওয়াসিপুরে’র মতো ‘গ্যাং অফ শালিমার’ তৈরি হবে, তা পুলিশের দুঁদে তদন্তকারীরা বুঝে উঠতে পারেননি। তাঁরা বুঝতে পারেননি, এলাকায় দুষ্কৃতীদের ‘মসিহা’ হয়ে ওঠা শাসকদলের এক শ্রেণির নেতার প্রশ্রয়ে শালিমার হয়ে উঠবে অপরাধ এবং অপরাধীদের ধাত্রীভূমি, বোঝেননি বিরোধী-শূন্য শালিমারে ওই নেতারা সিন্ডিকেট দখল করে বহুতল আবাসনের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের একচ্ছত্র সম্রাট হয়ে উঠবেন। আর তাঁদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে শালিমারে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করবে ‘গ্যাং অব শালিমার’।
দক্ষিণ হাওড়ার তৃণমূলের এক পুরনো নেতা বলেন, “মাত্র দুই বর্গ কিলোমিটার আয়তনের শালিমারে এখন টাকা উড়ছে। সেই টাকা লোটার খেলায় পুলিশ-আরপিএফ-রেল পুলিশের একাংশ-সহ জেলার বড় নেতারা জড়িয়ে পড়েছেন। পুরনো কর্মীরা এখানে ব্রাত্য।” যদিও দক্ষিণ হাওড়ার দলের কোনও নেতা শালিমার থেকে তোলাবাজি করছে, এমন কোনও অভিযোগ তাঁর কাছে আসেনি বলে জানাচ্ছেন দক্ষিণ হাওড়ার বিধায়ক নন্দিতা চৌধুরী। তাঁর দাবি, “যদি শালিমারে তোলাবাজি হয়ে থাকে, তা হলে তা করা হচ্ছে শিবপুর ও মধ্য হাওড়া থেকে। দক্ষিণ হাওড়ার কোনও নেতা, কর্মী এতে জড়িত নন।”
তবে এলাকার বাসিন্দাদের মতে, সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক গ্রাস করছে বস্তির সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকদের। রাস্তাঘাট আগের তুলনায় দ্রুত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। স্টেশন চত্বরের হ্যালোজেনের তীব্র আলো সত্ত্বেও জেগে থাকছে অপরাধের অন্ধকার।
(চলবে)