প্রয়াত হলেন বাবু পাল। —ফাইল চিত্র।
পুজোর আগে শোকের আঁধারে ‘আলোর শহর’ চন্দননগর! দুর্গাপুজো মানেই যে মানুষটা ছিলেন সবচেয়ে কর্মব্যস্ত, জগদ্ধাত্রী পুজো এলে যাঁর দম ফেলার ফুরসত থাকত না, সেই বাবু পাল প্রয়াত। আলোকশিল্পীর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। তিন বছর ধরে ক্যানসারে ভুগছিলেন। পরিবার সূত্রের খবর, মঙ্গলবার গভীর রাতে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাবু।
বিদেশের আঙিনায় চন্দননগরের আলোর খ্যাতি অনেক দিনের। এ শহরে বহু আলোকশিল্পী রয়েছেন। চন্দননগরে ‘আলোর জাদুকর’ বলা হয় শ্রীধর দাসকে। দেশ-বিদেশে নানা রকম ঘটনাকে আলোর সাজে ভরিয়ে তোলেন তিনি। বাবু ছিলেন শ্রীধরের যোগ্য উত্তরসূরিদের অন্যতম। নিজের সৃষ্টিশীলতার জোরে চন্দননগরের আলোর শিল্পকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যান বাবু। তাঁর আলোকসজ্জা সাত বার গিয়েছে দুবাইয়ের ‘শপিং ফেস্টিভ্যাল’-এ। ঢাকার দুর্গাপুজো বা রাশিয়ার হরেকৃষ্ণ মন্দিরও সেজেছে তাঁর আলোয়। পুজোর মরসুমে তিনি দম ফেলার ফুরসত পেতেন না। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকেও তাঁর কাছে আলোসজ্জার বরাত আসত। ২০১৬ সালের দীপাবলিতে আরব সাগরের পার থেকে ‘বিগ বি’র ডাক পেয়েছিলেন তিনি। মুম্বইয়ে অমিতাভ বচ্চনের তিনটি বাড়ি ‘প্রতীক্ষা’, ‘জলসা’ এবং ‘জনক’ সেজেছিল বাবুর আলোয়। রাজ্যের বিভিন্ন পুজো মণ্ডপের পাশাপাশি দুর্গাপুজোর কার্নিভালে রেড রোডকেও আলোয় সাজিয়েছেন তিনি। হালে কলকাতার শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের দুর্গাপুজোর আলোকশিল্পীও ছিলেন বাবু।
কলকাতার বড় বড় দুর্গাপজো হোক কিংবা চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা— বাবু পালের আলো মানেই আলাদা করে দর্শনার্থীদের নজর। কল্কা আর টুনি বাল্বের বিবর্তন ঘটিয়ে এলইডি আলো দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। সফল হন। বাবুর আলোকসজ্জার বিশেষত্ব ছিল সাম্প্রতিক ঘটনা থিমের মাধ্যমে আলোয় উপস্থাপন। যা দেখলে দর্শকের ‘জিয়া নস্ট্যাল’ হত। তবে বাবুর কাজের ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ মূলত ছিল ছোটরা। যে কোনও অনুষ্ঠানে কমবয়সিদের কথা ভেবে কিছু না কিছু মজার আলোকসজ্জা তৈরি করতেন। এ ভাবেই চন্দননগরের আলোয় তৈরি হয়েছে ডিজ়নি ল্যান্ড। অলিম্পিক্স থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল, বাবুর আলোর কারসাজি মানেই ঝকঝকে ‘ম্যাজিক’। লোকে বলে, সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে বাবু এগিয়ে ছিলেন তাঁর ভাবনা এবং সৃষ্টিশীলতায়।
এমন শিল্পীর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘করোনার সময় দু’বছর কোনও কাজ ছিল না। তখনও কর্মচারীদের ছুটি দেননি বাবু। অন্য আলোকশিল্পীদের পাশেও সেই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েছিলেন।’’ সজল চোখে তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘বাবুদার চলে যাওয়া আমাদের কাছে অভিভাবককে হারানোর মতো।’’
আদতে বাবুর তিন পুরুষের ব্যবসা ছিল লোহার কারবারের। কলকাতার বড়বাজারে দোকান ছিল তাঁদের। বিকম পাশ করার পরে সেই পারিবারিক ব্যবসারই দেখাশোনা করতেন বাবু। সেই সময় এক বন্ধুকে আলোর ব্যবসায় টাকা ধার দিয়েছিলেন। বন্ধু ব্যবসা তুলে দেন। টাকার বদলে আলোগুলি দিয়ে দেন বাবুকে। তার পরেই ‘ব্যবসায়ী’ বাবুর ‘শিল্পী’ বাবুতে উত্থান। এক সময়ে আলোর কাজে এমনই মজেন যে, পারিবারিক লোহার ব্যবসা বন্ধ করে শুধু আলোর কাজেই মন দেন। তিনি অসুস্থ থাকার সময় ব্যবসা দেখাশোনা করতেন স্ত্রী চিত্রলেখা পাল।
বুধবার বাবুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা। আসেন চন্দননগরের মেয়র রাম চক্রবর্তী, ডেপুটি মেয়র মুন্না আগরওয়াল প্রমুখ। মেয়র বলেন, ‘‘বাবু পাল নেই। কিন্তু তাঁর কাজ থেকে যাবে।’’ চন্দননগর কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটির সম্পাদক শুভজিৎ সাউয়ের মন্তব্য, ‘‘শিল্পীর কখনও মৃত্যু হয় না। বাবু পাল অনেক কষ্ট করে নিজেকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছিলেন। শ্রীধর দাসের হাত ধরে যেমন অনেক শিল্পী তৈরি হয়েছেন, বাবু পালও ছিলেন তেমনই। তাঁর কাছ থেকে কাজ শিখলেন যাঁরা, তাঁরাই চন্দননগরের আলোকশিল্পকে বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বল করবেন।’’ আর আলোকশিল্পী শ্রীধরের কথায়, ‘‘বাবু আমার অনেক পরে কাজ শুরু করেছিল। নিজের চেষ্টায় ও এত দূর পৌঁছেছিল। ভাল লাগে যখন চন্দননগরের আলো মানেই বাবু পালের নাম আসে। ওর চলে যাওয়াটা দুঃখের।’’