Debraj Chakraborty

জোড়াফুল ছেড়ে কংগ্রেসে, জেলে যাওয়া, ভোটে জিতে তৃণমূলে ফিরে নেতা হওয়া, তাঁর উত্থান ‘দেবরাজকীয়’

যে পূর্ণেন্দু বসুর সঙ্গে দেবরাজের ‘সংঘাত’ বেধেছিল, ২০২১-এর ভোটে তাঁকে আর টিকিট দেয়নি তৃণমূল। তাঁর বদলে বিধায়ক হন সঙ্গীতশিল্পী অদিতি মুন্সী। দেবরাজের স্ত্রী।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৫৩
দেবরাজ চক্রবর্তী। ছবি: ফেসবুক থেকে।

দেবরাজ চক্রবর্তী। ছবি: ফেসবুক থেকে।

এক বছর আগে এই সময়ে দেবরাজ চক্রবর্তীকে দেখা গিয়েছিল কাতারে। বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচের গ্যালারিতে। সঙ্গে স্ত্রী অদিতি মুন্সী। পরনে আর্জেন্টিনার জার্সি। হাতে ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ পতাকা। মুখে ঝকঝকে হাসি। এক বছর পরে সেই দেবরাজের বাড়িতে হানা দিল সিবিআই। কিন্তু তখনও তাঁর মুখের হাসিটি অমলিন।

Advertisement

বিধাননগর পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর দেবরাজের দু’টি বাড়িতে বৃহস্পতিবার তল্লাশি চালায় সিবিআই। একটি বাড়ি রাজারহাটে। অন্যটি দমদম পার্কে। সব মিলিয়ে প্রায় পৌনে পাঁচ ঘণ্টা তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ চলে। সেই তল্লাশির পরেও দেবরাজ ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে জানিয়েছেন, সত্যই সবচেয়ে শক্তিশালী। কোনও প্রাসঙ্গিক নথিপত্র পাওয়া যায়নি। পাশাপাশিই তিনি জানিয়েছেন, ভবিষ্যতেও তিনি তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। তিনি নিশ্চিত যে, সময় সত্য উদ্ঘাটিত করবে। মুখে স্মিত হাসি নিয়েই বলেছেন, ‘‘এটা সকলেই এখন বুঝতে পারছেন যে, এই তদন্ত আসলে রাজনৈতিক কারণেই।’’

প্রসঙ্গত, দেবরাজকে এই প্রথম যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করল, তা নয়। গত বছর অক্টোবরে তাঁকে ভোট-পরবর্তী হিংসা মামলায় সিজিও কমপ্লেক্সে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সিবিআই। তখনও তাঁর মুখে লেগেছিল সেই হাসিটি।

বস্তুত, দেবরাজকে কেউ কখনও রাগতে দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। সারা ক্ষণই হাসি লেগে থাকে তাঁর মুখে। তবে এ হেন দেবরাজই এক বার রাজ্যের মন্ত্রীর সঙ্গে সংঘাতে তৃণমূল ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন কংগ্রেসে। এবং তাঁর জনপ্রিয়তা এমনই ছিল যে, তৃণমূলের ভরা বাজারেও কংগ্রেসের হয়ে পুরভোটে জিতেছিলেন তিনি। এমনকি, ভোটের দিন তাঁকে গ্রেফতারও হতে হয়েছিল। তার পরে দেবরাজ আবার তৃণমূলে ফিরেছেন, নেতা হয়েছেন। যত সময় এগিয়েছে, তত তিনি ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে উঠেছেন দলে এবং সংগঠনে। বিধাননগর পুরসভার মেয়র পারিষদ তথা যুব তৃণমূল নেতা দেবরাজের বাড়িতে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সিবিআই হানা দেওয়ার পর থেকে দলের মধ্যে এবং রাজারহাট এলাকায় আরও এক বার ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে তাঁর উত্থান-কাহিনি।

একদা দেবরাজ ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা রাজারহাট-গোপালপুরের প্রাক্তন বিধায়ক পূর্ণেন্দু বসুর আপ্তসহায়ক। তখনও বিধাননগরের সঙ্গে রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার সংযুক্তিকরণ হয়নি। সেই পুরসভার একটি ওয়ার্ডে উপনির্বাচনে দেবরাজ প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে টিকিট দেওয়ায় বাদ সেধেছিলেন পূর্ণেন্দু। তখনই চিড় ধরে দু’জনের সম্পর্কে। এর পর রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার সঙ্গে বিধাননগর পুরসভাকে সংযুক্ত করে পুরসভা গঠন করে রাজ্য সরকার। তার প্রথম ভোট হয় ২০১৫ সালে। দেবরাজ ফের প্রার্থী হতে চান। ফের বাধা আসে। কিন্তু সে বার বাধা মানেননি দেবরাজ। তৃণমূল ছেড়ে যোগ দেন কংগ্রেসে। ‘হাত’ চিহ্নে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হন তরুণ এই নেতা। কিন্তু ভোটের রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নানাবিধ অভিযোগ দায়ের হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। দেবরাজ জেলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভোটে জিতেছিলেন। বিরাট ব্যবধানে।

জামিন পাওয়ার পরে তিনি ফিরে যান তৃণমূলে। সেই ফেরা ছিল আক্ষরিক অর্থেই ‘দেবরাজকীয়’। তৃণমূলে ফেরার পর কাউন্সিলর হিসাবে নিজেকে তিনি ক্রমশ অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে থাকেন। এতটাই যে, যুবদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা নিয়ে দলের মধ্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন অনেক প্রবীণও। এ সবের মধ্যেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলার যুব তৃণমূলের সভাপতি করা হয় দেবরাজকে। তখন রাজ্য যুব তৃণমূলের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলার যুব সংগঠনে দেবরাজের ভূমিকা অভিষেকের কাছেও তাঁর নম্বর বাড়িয়ে দেয়। ক্রমশ দলের মধ্যে ‘অভিষেকের লোক’ বলে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন এই তরুণ নেতা। সম্প্রতি যুব তৃণমূলের নতুন জেলা সভাপতিদের যে তালিকা ঘোষিত হয়েছে, সেখানেও দেবরাজকে দমদম-ব্যারাকপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি করা হয়েছে।

অভিষেক নিজে ২৪ ঘণ্টা রাজনীতি করেন । দেবরাজও তাই। অনেকে বলেন, সে কারণেই অভিষেকের চোখে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এখনও বয়স ৪০ ছোঁয়নি। দলের অনেকে বলেন, এর মধ্যেই দেবরাজ নিজেকে অন্য ঘরানায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় অভিষেকের রাজনৈতিক শৈলীর। তিনি সংবাদমাধ্যমের সামনে বিশেষ আসেন না। সংগঠন করেন ছক কষে। তথ্যপ্রযুক্তিকেও ব্যবহার করেন সমান্তরাল ভাবে।

২০১৮ সালে দেবরাজ বিয়ে করেন সঙ্গীতশিল্পী অদিতিকে। বৃহস্পতিবার দেবরাজের রাজারহাট রোডের বাড়ির পাশাপাশি দমদম পার্কে তাঁর যে ফ্ল্যাটে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে হানা দিয়েছিল সিবিআই, সেখানে অদিতির গানের অ্যাকাডেমি চলে। রাজারহাটের বাড়িতে মা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন দেবরাজ। বৃহস্পতিবার সকালে সিবিআই সেই বাড়িতেই প্রথম গিয়েছিল। তখন বাড়িতে ছিলেন না দেবরাজ। মায়ের ফোন পেয়ে বাড়িতে ফেরেন। ঢোকার সময় হাসিমুখে বলেন, ‘‘আগে গিয়ে দেখি বিষয়টা কী।’’

দু’টি বাড়িতে সিবিআইয়ের তল্লাশির পর মুখে হাসি ধরে রেখেই জানান, তদন্তকারী সংস্থা কোনও প্রাসঙ্গিক নথি পায়নি। দেবরাজের ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, তার পর থেকেই তরুণ নেতা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে।

পুনশ্চ: যে পূর্ণেন্দুর সঙ্গে দেবরাজের ‘সংঘাত’ হয়েছিল, ২০২১-এর ভোটে তাঁকে আর টিকিট দেয়নি তৃণমূল। তাঁর বদলে যাঁকে টিকিট দেওয়া হয়েছিল, ভোটে জিতে তিনিই পূর্ণেন্দুর জায়গায় বিধায়ক হন। তাঁর নাম অদিতি। অদিতি মুন্সী। দেবরাজের মুখের হাসিটি তখনও অমলিনই ছিল।

আরও পড়ুন
Advertisement