প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য গোপন বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন, দাবি ইডির। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদে একটি ‘গোপন বিভাগ’ তৈরি করা হয়েছিল। তা নিয়ন্ত্রণ করতেন পর্ষদের তৎকালীন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। নিয়োগ মামলার চার্জশিটে এমনটাই দাবি করেছে ইডি। তারা জানিয়েছে, পর্ষদের ওই গোপন বিভাগের নাম ‘টেট কনফিডেনশিয়াল’। একাধিক ‘ব্ল্যাঙ্ক’ চেক ওই নামে বরাদ্দ করা হত। তা অজানা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতেন মানিক স্বয়ং। ২০১২ সালের পর থেকে এই ধরনের ‘কনফিডেনশিয়াল’ বিল তৈরি করা শুরু হয়েছিল বলে জানতে পেরেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সম্প্রতি পঞ্চম অতিরিক্ত চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে ইডি। সেখানেই তারা দাবি করেছে, পর্ষদের কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে মানিক সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। মানিক পর্ষদ সভাপতি হওয়ার পর দফতরের বেশ কিছু নিয়মে বদল এনেছিলেন, কর্মীরা জানিয়েছেন ইডিকে। মৌখিক নির্দেশের মাধ্যমেই দফতরের একাধিক কাজ করাতেন তিনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কোনও নথিভুক্ত প্রমাণ থাকত না।
পর্ষদের গোপন বিভাগ সম্পর্কে খোঁজ নিতে অর্ণব বসু এবং গৌতম পুততুন্ড নামের দুই কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ইডি। অর্ণব ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চুক্তিভিত্তিক কর্মী। তাঁকে মৌখিক ভাবেই বিভিন্ন নির্দেশ দিতেন মানিক। ইডি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, মানিক সভাপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদে মৌখিক নির্দেশের চল ছিল না। ফাইলের মাধ্যমে নথিভুক্ত করে কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হত। কিন্তু মানিক আসার পরে এই চল বন্ধ করে দেন।
চার্জশিটে ইডি জানিয়েছে, পর্ষদের একটি ‘কনফিডেনশিয়াল সেকশন’ বা গোপন বিভাগ ছিল। তা সম্পূর্ণ ভাবে মানিকের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ওই বিভাগে চাকরিপ্রার্থীদের বিস্তারিত তথ্য পাঠাতেন মানিক। তাঁদের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতেন। ব্যক্তিগত বিষয় হলে সে সম্বন্ধে হোয়াট্সঅ্যাপেই খোঁজ নিতেন মানিক, জানিয়েছে ইডি। আর ব্যক্তিগত আগ্রহ না থাকলে সেই প্রার্থীর ক্ষেত্রে ইমেলের মাধ্যমে তথ্য পাঠাতেন তিনি।
২০০০ সাল থেকে পর্ষদের হিসাবরক্ষকের কাজ করেছেন গৌতম পুততুন্ড। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি জানতে পেরেছে, গোপন বিভাগের জন্য যে সমস্ত বিল বা রসিদ তাঁকে তৈরি করতে হত, সেগুলি অন্যান্য রসিদের চেয়ে আলাদা ছিল। কার উদ্দেশে রসিদ ইস্যু করা হচ্ছে, তার কোনও উল্লেখ থাকত না। মানিক সরাসরি ওই রসিদগুলির কাজ দেখতেন। এই সংক্রান্ত নির্দেশ আরসি বাগচীর মাধ্যমে গৌতমকে দিতেন মানিক। ২০১২ সালের পর থেকে ‘কনফিডেনশিয়াল’ বিভাগের বিল তৈরি শুরু হয়, জানিয়েছেন গৌতম। মানিকের মৌখিক নির্দেশে ওই বিল তৈরি হত। তার পর তা স্বাক্ষরের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হত। ‘টেট কনফিডেনশিয়াল’ শিরোনামে বিলগুলি পৌঁছত মানিকের কাছে। তাঁর মৌখিক নির্দেশের পর গৌতম ব্ল্যাঙ্ক চেক তুলে দিতেন আরসি বাগচীর হাতে। মানিক সেই চেক নিতেন এবং পাঠিয়ে দিতেন অজানা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। কার অ্যাকাউন্টে টাকা যেত, তা মানিক ছাড়া আর কেউ জানতে পারতেন না, দাবি ইডির। অর্থাৎ, কাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা যেমন জানা যেত না, তেমনই কত টাকা দেওয়া হচ্ছে, তা-ও অন্তরালেই থাকত। কী কারণে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অন্দরে এত গোপনীয়তা, তা নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে।
যে কোনও সংস্থায় প্রথমে সাধারণত কোনও কাজের জন্য বিল প্রস্তুত করা হয়। তার পর তা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিল যায় সংস্থার সচিবের কাছে। তিনি বিল দেখে পাঠান সভাপতির কাছে। সভাপতির অনুমতি দিলে সচিব বিলে সই করেন এবং আবার সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়ে দেন। বিলে সই থাকে সচিবেরই। এই সংক্রান্ত বিষয়ে ওয়াকিবহালেরা বলছেন, সচিবও এর দায় এড়াতে পারেন না।
উল্লেখ্য, প্রাথমিকে দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর পর্ষদের সভাপতি পদ থেকে মানিককে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। দু’বছর তিনি জেলে ছিলেন। সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন।