Abhishek Banerjee

ঘরে-বাইরে বহু ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়েছেন অভিষেক, কী কী পেরিয়েছেন? কিসে ‘ধাক্কা’? কিসেই বা ‘চ্যালেঞ্জ’?

অভিষেক কি কোনও দুর্যোগের পূর্বাভাস দিতে চেয়েছেন? অভিষেকের পোস্টে তা স্পষ্ট না হলেও দলের অনেকেই বলছেন, ঘরে-বাইরে অনেক উত্তাল ঢেউয়ের সামনে অভিষেককে পড়তে হয়েছে গত পাঁচ বছরে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৪ ১৫:২০
Discussions are going on in the TMC regarding Abhishek Banerjee\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s Instagram post

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।

তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজমাধ্যমে সারা ক্ষণ নজর রাখেন বলে দলে কথিত। তিনি যে খুব ঘন ঘন পোস্ট করেন, তা নয়। তবে করলে তার মধ্যে আলোচনার রসদ থাকে। যেমন, রবিবার সন্ধ্যায় অভিষেক তাঁর ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডলে নিজের ছবি দিয়ে যে আফ্রিকান প্রবাদ লিখেছিলেন, তা নিয়ে আপাতত আবর্তিত হচ্ছে তৃণমূল শিবিরের আলোচনা।

Advertisement

অভিষেক ইংরেজিতে লিখেছিলেন, ‘স্মুদ সি নেভার মেড আ স্কিলড্‌ সেলর’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, শান্ত সমুদ্র কখনও দক্ষ নাবিক তৈরি করতে পারে না। সেনাপতির সেই পোস্টের পর থেকেই তৃণমূলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে এই মর্মে যে, ‘নাবিক’ অভিষেক কি কোনও ‘দুর্যোগের পূর্বাভাস’ দিতে চেয়েছেন? তিনি কি অতীতের কথা বলতে চেয়েছেন? না কি ভবিষ্যতের কথা? অভিষেকের সংক্ষিপ্ত পোস্টে তা স্পষ্ট নয়। তবে দলের অনেকের মতে, ঘরে-বাইরে অনেক উত্তাল ঢেউয়ের সামনে অভিষেককে পড়তে হয়েছে গত পাঁচ বছরে। কোনওটা তিনি পেরিয়েছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘ধাক্কা’ খেতে হয়েছে। তবে সে সব সামলে ফের তৃণমূলের তরী বাইতে নেমেছেন তিনি। সেই প্রেক্ষাপটেই পাঁচটি বড় ঢেউয়ের কথা উল্লেখ করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠেরা, যা অভিষেক পেরিয়েছেন সাফল্যের সঙ্গে।

২০২১-এর বিধানসভা ভোট

২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বাংলায় ১৮টি আসন জিতেছিল বিজেপি। লোকসভার নিরিখে প্রায় ১৪০টি বিধানসভায় এগিয়ে ছিল পদ্মশিবির। সেই অঙ্ক নিয়েই বিজেপি বাংলা দখলে ঝাঁপিয়েছিল ২০২১সালে। কিন্তু লোকসভা ভোট পরবর্তী পর্যায়ে প্রশান্ত কিশোরকে দলের সঙ্গে যুক্ত করে তৃণমূল। সাহায্য নেয় পরামর্শদাতা সংস্থার। তার মূল হোতা ছিলেন অভিষেক। সেই সময়ে অভিষেক এবং প্রশান্ত কিশোর শুধু যে প্রচারের নবনির্মাণ করেছিলেন তা-ই নয়, সাংগঠনিক রীতিতেও বদল এনেছিলেন। জেলায় জেলায় পর্যবেক্ষক ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছিল। প্রচারের ‘আখ্যান’ তৈরি থেকে স্লোগান নির্ধারণ— সবেতেই পেশাদার সংস্থা এবং অভিষেকের যুগলবন্দি দেখা গিয়েছিল। বিজেপিকে থামতে হয়েছিল ৭৭টি আসনে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয় অভিষেকের নেতৃত্বকে ‘প্রতিষ্ঠিত’ করেছিল তৃণমূলে। ভোটের ফল ঘোষণার এক মাসের মধ্যেই অভিষেককে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

ইডি-সিবিআই

২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত একাধিক বার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তলব পেয়েছেন অভিষেক। সেই ‘ঢেউ’ও অভিষেক এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক ভাবে এবং আইনি লড়াই লড়ে সামাল দিচ্ছেন। কয়লা মামলায় এক বার ইডির তলবে দিল্লি গিয়ে হাজিরা দিয়েছিলেন। ফের তাঁকে দিল্লিতে তলব করায় সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন অভিষেক। তাঁর আইনজীবীরা আদালতে যুক্তি দিয়েছিলেন, কলকাতায় ইডির দফতর থাকতেও কেন দিল্লিতে বার বার তলব? এটা কি ‘হেনস্থা’ নয়? দীর্ঘ শুনানির পর শীর্ষ আদালত নির্দেশ দেয়, অভিষেককে জেরা করতে হলে কলকাতাতেই করতে হবে। অভিষেকের স্ত্রীকেও একাধিক মামলায় তলব করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তলব করেছে অভিষেকের বাবা-মাকেও। দলের অনেকের বক্তব্য, দু’ভাবে লড়াই করে অভিষেক এখনও পর্যন্ত ইডি-সিবিআইয়ের ঢেউ সামলাতে পেরেছেন। তবে তাঁরা এ-ও বলছেন, যে কোনও সময়ে আবার সেই ঢেউয়ের সামনে পড়তে হতে পারে অভিষেককে।

২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট

২০২২ সালের নভেম্বর থেকে দু’মাস ব্যাপী ‘নবজোয়ার যাত্রা’ করেছিলেন অভিষেক। কোচবিহার থেকে সাগর পর্যন্ত। মাঝে দেড় দিনের জন্য সিবিআই তলবে হাজিরা দিতে কলকাতায় ফেরেন। টানা দু’মাস ছিলেন বাড়ির বাইরে। উদ্দেশ্য ছিল, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তিনটি স্তরে কারা কোথায় প্রার্থী হবেন, সে ব্যাপারে সাংগঠনিক ভোটগ্রহণ এবং প্রচার। গোপন ব্যালটে অধিবেশন করে ভোট নিয়েছিলেন। মূলত ‘গোষ্ঠীকোন্দল’ রুখতেই ওই পদ্ধতি অভিষেক অবলম্বন করেছিলেন বলে মত দলের অনেকের। তার পরবর্তীকালে জেলা পরিষদের সভাধিপতি বা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ঠিক করে দেওয়ার নেপথ্যেও অভিষেকের ভূমিকা ছিল বলেও দলের প্রথম সারির অনেকের দাবি। গোষ্ঠীলড়াই সামলে পঞ্চায়েতে ভাল ফল করেছিল তৃণমূল। মনোনয়ন জমা দিতে না-দেওয়ার মতো ‘গা-জোয়ারি’র অভিযোগ তোলেননি বিরোধীরা।

২০২৪-এর লোকসভা ভোট

নবজোয়ার যাত্রার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ১০০ দিনের কাজ ও আবাস যোজনার বকেয়া টাকা আদায়ের দাবিতে অভিষেক আন্দোলন নিয়ে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। ওই বিষয়ে ‘বাংলার বঞ্চনা’র রাজনৈতিক আখ্যান তৈরি করে কেন্দ্রের উপর ‘চাপ’ তৈরি করেছিলেন তিনি। যা ছিল ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু মাঝে একটা সময়ে ‘নিষ্ক্রিয়’ ছিলেন অভিষেক। যদিও ভোটের কয়েক মাস আগে দলের মূলস্রোতে ফিরে ‘সক্রিয়’ হন তিনি। লোকসভা ভোটে প্রার্থী ঠিক করা থেকে প্রচারের নকশা তৈরি—সবেতেই অভিষেকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তৃণমূলের প্রথম সারির এক নেতার বক্তব্য, ‘‘এই লোকসভায় বিজেপি ভাল ফল করলে অভিষেকের নেতৃত্ব নিয়ে দলে প্রশ্ন উঠত। সেই অবকাশ আর নেই।’’

সাংগঠনিক সংস্কার

ভোটের পরেই অভিষেক প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন, তিনি চিকিৎসার জন্য সংগঠন থেকে ‘ছোট বিরতি’ নিচ্ছেন। পাশাপাশি সরকারের কাজের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে কিছু আর্জিও জানিয়েছিলেন তৃণমূলের সেনাপতি। তার মধ্যে অন্যতম, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যাতে আবাস যোজনার টাকা রাজ্য সরকার উপভোক্তাদের দিয়ে দেয়। যা ছিল লোকসভা ভোটের প্রতিশ্রুতি। অভিষেকের সেই ‘ছোট বিরতি’ নিয়ে নানা জল্পনা তৈরি হয়েছিল। তাঁর ঘনিষ্ঠেরা জানিয়েছিলেন, সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও আমলার কাজে অভিষেক বিরক্ত। তিনি চান, যাঁরা সময়ের কাজ সময়ে করতে পারছেন না, পরিষেবা দিতে বিলম্ব করছেন, তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। প্রশাসন হোক ‘গতিশীল’। তাতে জনমানসে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। এক ধাপ এগিয়ে তিনি ২১ জুলাই ঘোষণা করেন, আগামী তিন মাসে সংগঠন ও স্থানীয় স্তরের প্রশাসনে অনেক রদবদল হবে। সেই কাজ বাস্তবায়িত করতেও অভিষেককে নতুন ‘ঢেউয়ের’ সামনে পড়তে হবে বলে অভিমত অনেকের। আসতে পারে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তিও।

তবে সংগঠনে অভিষেককে অনেক ধাক্কাও খেতে হয়েছে। দলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে বাংলার বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে তৃণমূলের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন অভিষেক। গোয়া, ত্রিপুরার মতো রাজ্যে ধারাবাহিক যাতায়াতও করেছিলেন। কিন্তু সে ভাবে নির্বাচনী সাফল্য পাননি। অভিষেক চেয়েছিলেন, দলে ‘এক ব্যক্তি-এক পদ’ নীতি বাস্তবায়িত করতে। তা-ও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রাজনীতিতে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়ার পক্ষে তিনি যে জোরাল সওয়াল করেছিলেন, সেই প্রশ্নেও অভিষেক খানিকটা ‘নমনীয়’ হয়েছেন বলে মনে করছেন অনেক। কারণ, ২১ জুলাইয়ের বক্তৃতায় অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘নবীনদের উদ্দীপনা আর প্রবীণদের অভিজ্ঞতা নিয়েই দল চলবে।’’

তবে অভিষেকের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘অভিষেক চান, রাজনীতিতে উথালপাথাল চলুক। তবেই রাজনীতি উপভোগ করা যাবে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জ আসবেই। অভিষেক সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পছন্দ করেন। তাঁর কাছে আগামী বিধানসভা ভোট অবশ্যই চ্যালেঞ্জের। যখন তৃণমূলকে টানা ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়ে ভোটে যেতে হবে। অভিষেকের পোস্টকে সেই ‘ঢেউ’-এর আঙ্গিকেও দেখা যেতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement