বামেদের সমাবেশে থাকবে জোট শরিক কংগ্রেসও।
ভোটমুখী বাংলায় বামপন্থী নেতাদের মুখে নতুন স্লোগান— ‘হাল ফেরাও, লাল ফেরাও’। যে স্লোগানে বলা হচ্ছে তৃণমূলকে হঠিয়ে আবার বামেদের ক্ষমতায় আনার কথা। সেই লক্ষ্যের শুরু ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশে। যেখানে বামেদের সমাবেশে থাকবে জোট শরিক কংগ্রেসও। সমাবেশে বক্তার তালিকা এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে বামেদের তরফে শরিক নেতাদের পাশাপাশি থাকবেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। কংগ্রেস সূত্রের খবর, রাহুল গাঁধী এবং প্রিয়াঙ্কা গাঁধী বঢরা ব্রিগেড সমাবেশে অন্যতম বক্তা হিসেবে আসতে পারেন। তাঁদের সময় নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে লড়ার কথা জানিয়েছে বাম-কংগ্রেস। ফলে এ বারের ব্রিগেড হবে জোটের ব্রিগেড। দু’টি দল থেকেই নেতা-কর্মী-সমর্থকরা সভায় আসবেন। ফলে ব্রিগেডে বিপুল লোকের জমায়েত হবে বলে আশা করছেন জোট নেতৃত্ব। তাঁদের ধাররণা, সব মিলিয়ে ১০ লক্ষের বেশি মানুষ ব্রিগেডে আসবেন। যা সাম্প্রতিককালের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেবে। জোট নেতাদের দাবি, ‘ঐতিহাসিক’ হতে চলেছে এ বারের ব্রিগেড।
সেই ‘ইতিহাস’ গড়ার লক্ষ্যে পাশাপাশিই সিপিএমের প্রচারে ঢুকে পড়েছে সম্প্রতি নেটমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ টুম্পাসোনা। টুম্পার গানের অনুসরণে ব্রিগেডমুখী একটি গান ইতিমধ্যেই নেটমাধ্যমে ঘুরছে। মূলত বামপন্থীরা গানটি তাঁদের নেটমাধ্যমে ‘শেয়ার’ করতে শুরু করেছেন। সেই গানের কথা যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহ যে, এ জিনিস সিপিএমের যুবদের ‘রসিক এবং সজাগ মস্তিষ্ক’ ছাড়া অসম্ভব। আনুষ্ঠানিক ভাবে এর পিতৃত্ব স্বীকার করেনি আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। কিন্তু গানের সঙ্গে কার্টুনে লালঝাণ্ডায় স্পষ্ট কাস্তে-হাতুড়ি দেখা যাচ্ছে। ঘটনাচক্রে, টুম্পার ব্রিগেডের গানটিও ‘ভাইরাল’ হওয়ার পথে। এতটাই যে, শাসক তৃণমূল শিবিরের নেতারাও নির্মল আনন্দ পেতে ঘরোয়া স্তরে সেটি একে অপরকে হোয়াট্সঅ্যাপে পাঠাতে শুরু করেছেন। যদিও গানে তাঁদের সঙ্গে বিজেপি-র সমঝোতার কথা বলে সেটিকে ‘বিজেমূল’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গানের ধুয়োয় ঘুরেফিরে এসেছে ‘টুম্পা, তোকে নিয়ে ব্রিগেড যাব। টুম্পা, চেন-ফ্ল্যাগে মাঠ সাজাব’।
প্রসঙ্গত, বামনেতৃত্ব প্রতিবারের মতো এবারেও জেলার নেতাদের লোক আনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন। তবে কোভিড পরিস্থিতির কারণে অনেক ট্রেন না চলায় সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা নিয়ে খানিক উদ্বেগে অনেক জেলার নেতা। উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে সেই আশঙ্কা আরও বেশি। কোচবিহারের এক নেতার কথায়, ‘‘আমাদের জেলা থেকে ২,০০০-এর লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ট্রেন কম চলায় টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ব্রিগেড নিয়ে কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ থাকায় গাড়ি করে তাঁদের নিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। তবে সে ক্ষেত্রে খরচের দিকটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।’’ একই সমস্যায় দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলা। তবে মালদহের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। সেখানকার এক নেতা বলছেন, ‘‘অন্যবারের মতো এবারেও আমাদের ৮,০০০ লোক নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আমরা তার থেকেও বেশি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি। ট্রেনের পাশাপাশি বাস ও গাড়ি করেও আমরা লোক নিয়ে যাব।’’
বরাবরই উত্তরের তুলনায় দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি থেকে বেশি লোক আনার উপর জোর দেন বামনেতারা। সেই মতো মুর্শিদাবাদ থেকে ৭৫,০০০ এবং দুই বর্ধমান থেকে দেড় লক্ষের বেশি লোক আনার লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। সিপিএমের রাজনীতিতে বরাবরই ‘বর্ধমান লবি’ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তাদের দাপটও অনেক বেশি। দুই বর্ধমান জেলারই নেতাদের দাবি, তাঁরা লক্ষ্যের চেয়েও বেশি লোক ব্রিগেডে নিয়ে আসবেন। পূর্ব বর্ধমানের এক নেতা বলেন, ‘‘ব্রিগেডের আহ্বান জানিয়ে এলাকা ভিত্তিক ছোট ছোট পথসভা, মিছিল করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। এখন আমরা হাওয়া তৈরি করছি। এরপর তা ঝড়ে পরিণত হয়ে ব্রিগেডের মাঠে আছড়ে পড়বে।’’ একই সুর হুগলির সিপিএম জেলা নেতাদের গলাতেও। তাঁরা জানাচ্ছেন, হুগলি থেকে ৫০,০০০-এরও বেশি লোক ব্রিগেডে আসবেন।
গত লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহলে বামেরা খুব খারাপ ফল করেছিল। তবে সেখানে তাঁরা হারানো জমি ফিরে পাচ্ছেন বলে বামনেতাদের দাবি। বাঁকুড়ার এক নেতা বলছেন, ‘‘লোকসভা ভোটে আমরা একটি বিধানসভা আসনেও এগিয়ে ছিলাম না। এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের জেলা থেকে ২৫,০০০ মানুষ ব্রিগেডে যাবেন।’’ আবার পুরুলিয়ার নেতাদের দাবি, সেখান থেকে ২০,০০০ লোক মহাজোটের সভায় আসবেন। জঙ্গলমহলের অন্যতম জেলা ঝাড়গ্রাম থেকে ৪,০০০ লোক আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সিপিএম। অন্য দিকে, দুই মেদিনীপুর থেকে মোট দেড় লক্ষ লোক আনার লক্ষ্য রয়েছে সিপিএমের। তবে বামেদের বক্তব্য, ব্রিগেডের সভায় সবচেয়ে বেশি লোক আসবেন কলকাতা লাগোয়া জেলাগুলি থেকে। শুধুমাত্র উত্তর ২৪ পরগনা থেকেই দেড় লক্ষের বেশি লোক আনার প্রস্তাব দিয়েছেন জেলা নেতৃত্ব। পাশাপাশি, দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে ১ লক্ষ এবং হাওড়া থেকে ৮০,০০০-এর বেশি মানুষ ব্রিগেডে আসবেন বলে দাবি সিপিএমের। কলকাতায় থেকে বামেদের সভায় যোগ দেবেন ১ লক্ষের বেশি মানুষ।
ব্রিগেডে বামেদের পাশাপাশি কংগ্রেসও থাকায় অনেক জেলায় দু’দল একসঙ্গে প্রচার করছে। সেক্ষেত্রে বামেদের লক্ষ্যমাত্রার বাইরেও লোকসংখ্যা বাড়বে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। আবার আলাদা করে আব্বাসের কর্মী-সমর্থকেরা যোগ দিলে সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই উদ্যোক্তাদের আশা। সব মিলিয়ে বামনেতারা মনে করছেন, ভিড়ের নিরিখে অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে মহাজোটের ব্রিগেড। ১০ লক্ষের বেশি মানুষ ব্রিগেডে অংশগ্রহণ করবেন।
বাংলার ভোটের রাজনীতিতে ব্রিগেড বরাবরের যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে থেকেছে। যে পরিসরে নিজেদের শক্তি জাহির করতে চায় সব রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের সময় ব্রিগেড ছাড়াও বড় বড় সভা বা মিছিল হলেও দলীয় কর্মীদের কাছে ব্রিগেড সমাবেশের উৎসাহ আলাদা। সাংগঠনিক দিক থেকেও ব্রিগেড সমাবেশের ফায়দা রয়েছে। অপর এক বামনেতার কথায়, ‘‘ব্রিগেড সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য দেওয়াল লিখন, পোস্টার, পথসভা, মিছিল এবং প্রচারপত্র বিলির পাশাপাশি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েও প্রচার করা হয়। ফলে জনসংযোগ বাড়ে। ফলে নেতারা বুঝতে পারেন, সংগঠন কোথায় দুর্বল এবং কোথায় শক্তিশালী। যেমন এ বারের ব্রিগেড-প্রচারে গিয়ে বোঝা গিয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা, কেশপুরে বামেরা শক্তিশালী হচ্ছে। তাই পরোক্ষ ভাবে হলেও ব্রিগেডের গুরুত্ব রয়েছে।’’
বাম ব্রিগেডের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হচ্ছে না। লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রায় প্রতিবার ব্রিগেডে সভা করে বামেরা। কারণ, ব্রিগেড সমাবেশে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা হয়। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে কর্মীরা এক জায়গায় জড়ো হন। যুদ্ধের জন্য সেনা প্রস্তুতির মতো। তার মধ্যে তারকা বক্তাদের ভাষণের ফুলঝুরি। তাঁদের পাশাপাশিই এ বার থাকছে ‘টুম্পা, তোকে নিয়ে ব্রিগেড যাব। টুম্পা, চেন-ফ্ল্যাগে মাঠ সাজাব’।