Pradip Bhattacharya on Mamata Banerjee

মমতা-বহিষ্কারের প্রায়শ্চিত্ত করছে কংগ্রেস! সোমেনের মূর্তি উদ্বোধনে বিতর্কের সলতেয় ‘আগুন’ প্রদীপের

১৯৯৭ সালে মমতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কংগ্রেস। তার পরেই মমতার হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে তৃণমূল। ২৮ বছর আগের সেই স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে যেন আক্ষেপের সুর প্রদীপ ভট্টাচার্যের গলায়।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:২৯
Congress leader Pradip Bhattacharya says the decision to expel Mamata Banerjee was wrong

(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ ভট্টাচার্য, অধীর চৌধুরী এবং শুভঙ্কর সরকার। —ফাইল চিত্র।

২৮ বছর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বহিষ্কারের ঘটনাই এ রাজ্যে ‘খাদে’ ফেলে দিয়েছিল কংগ্রেসকে। প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এবং প্রাক্তন সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের মন্তব্য তাঁর দলের অভ্যন্তরে অস্বস্তিই শুধু জাগায়নি, পুরনো বিতর্কের সলতেতে আবারও আগুন ধরিয়ে দিল নতুন এক পরিস্থিতিতে। যে সোমেন মিত্র প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন মমতাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, সেই সোমেনের মূর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানেই প্রদীপের এই মন্তব্য। মধ্য কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারে কংগ্রেসের দলীয় দফতরের কাছেই মূর্তির উন্মোচন হয় শনিবার। প্রদীপ সেখানে বলেন, মমতাকে বহিষ্কারের ‘‘প্রায়শ্চিত্ত দলকে আজও করতে হচ্ছে।’’

Advertisement

প্রদীপ যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতার বহিষ্কার নিয়ে ‘আক্ষেপ’ করছিলেন, তখন তাঁর পাশেই বসে ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি শুভঙ্কর সরকার। কিন্তু তিনি প্রদীপের বক্তব্য ‘শুনতে পাননি’। শুভঙ্করের কথায়, ‘‘প্রদীপদা ঠিক কী বলেছেন আমি শুনিনি। অনেকেই বলছেন আমি নাকি সেই বক্তৃতার সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু কোনও কারণে হয়তো প্রদীপদার বক্তৃতার ওই অংশটি আমি শুনিনি। আজ সকাল থেকেই আমি দার্জিলিংয়ে বৈঠকের মধ্যে আছি। অনেক সংবাদমাধ্যমই আমাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। আমিও প্রদীপদার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। শুনলাম তিনি বর্ধমানে রয়েছেন। আমি ফোনে চেষ্টা করেও তাঁকে পাইনি। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে তার পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাব। আর প্রদীপদার কথার ব্যাখ্যা প্রদীপদা নিজেই দেবেন।’’

ঘটনাচক্রে, শুভঙ্কর যাঁর বদলে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদে এসেছেন কয়েক মাস আগে, সেই অধীর চৌধুরী কট্টর মমতা-বিরোধী বলে পরিচিত। সরাসরি প্রদীপের সমালোচনা না-করেও অধীর তাঁর অবস্থান জানিয়ে দিলেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’ প্রসঙ্গে। তাঁর কথা, ‘‘প্রদীপদা সিনিয়র নেতা। উনি যা বলেছেন, তা নিয়ে আমি কিছু বলব না। তবে আমরা মমতার অত্যাচার সহ্য করতে করতে রাজনীতি করছি। ২০১১ সালে যখন সনিয়া গান্ধী বললেন, তৃণমূলের সঙ্গে জোট করতে হবে, তখন আমি ‘না’ বলিনি। সেই ভোটে কংগ্রেস টাকা দিয়ে সাহায্য করল, হেলিকপ্টার দিল। মমতা ক্ষমতায় এলেন। তার পর তাঁর রূপ সবাই দেখতে পেয়েছে। এ বার বুঝুক, কে কার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করছে।’’ কংগ্রেসের আর এক ‘কট্টর মমতা-বিরোধী’ নেতা এবং বিধানসভার প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান অবশ্য প্রদীপের মত নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি নন।

কী বলেছেন প্রদীপ?

মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রদেশ কংগ্রেসের সোমেন জমানা এবং বাংলায় কংগ্রেসের দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরেন প্রদীপ। সেখানেই তিনি বলেন, ‘‘কেন কংগ্রেস দলটা খণ্ডিত হয়ে গেল? আমার মনে আছে, যে দিন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দল থেকে বহিষ্কার করা হল, আমি সে দিন শ্রীরামপুর থেকে ফিরছিলাম। আমি যখন দ্বিতীয় হুগলি সেতুর সামনে, সোমেনের ফোন এল। সীতারাম কেশরী ওঁকে বলেছেন, ‘মমতাকে তোমাদের বহিষ্কার করতে হবে, কারণ আমরাও করেছি।’ আমি বলেছিলাম, এটা কিছুতেই কোরো না। কিন্তু সোমেনের উপরে এমন চাপ তৈরি করা হয়েছিল যে, এটা করতে তিনি বাধ্য হন। তার প্রায়শ্চিত্ত কংগ্রেসকে আজও করতে হচ্ছে। আমি জানি না, এই খাদ থেকে আমরা কখন, কী ভাবে উঠতে পারব।’’

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মমতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় কংগ্রেস। ২২ ডিসেম্বর মমতা নতুন দল তৈরির কথা ঘোষণা করেন। তাঁর হাত ধরে তৃণমূলের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি। এর পর তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কে নানান ওঠাপড়া এসেছে। ২০০১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বিধানসভো ভোটে লড়েন মমতা। তবে সেই জোট মূলত খাতায় কলমেই হয়। ভোটের পর ভেঙেও যায়। ২০০৮ সালে সিপিএম কেন্দ্রে মনমোহন সিংহ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের পর মমতা আবার কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলান। এর পর ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১১-র বিধানসভা ভোটে জোট করে লড়ে তৃণমূল এবং কংগ্রেস। রাজ্যে টানা ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান হওয়ার পর মমতার ‘পরিবর্তনের সরকার’ গঠিত হয় কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়েই। তার পর, বছর খানেকের একটু বেশি এই জোট টিকেছিল। পরবর্তীতে আর কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে রাজ্যস্তরে জোট হয়নি তৃণমূলের।

তবে গত বছর লোকসভা ভোটের আগে কেন্দ্রীয় ভাবে তৈরি বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ এক মঞ্চে নিয়ে যায় মমতা এবং রাহুল গান্ধীদের। বাংলাতেও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট চেয়েছিলেন মমতা। কিন্তু কংগ্রেস হাইকমান্ড শেষ পর্যন্ত অধীরদের মত মেনে নিয়ে বামেদের সঙ্গে জোটে সায় দেয়। অধীর নিজে তাঁর ‘গড়’ বহরমপুরে পরাজিত হন। লোকসভায় বাংলার হয়ে এখন কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন মাত্র এক জন— মালদহ দক্ষিণের সাংসদ ঈশা খান চৌধুরী।

কংগ্রেসের অধীর-বিরোধীদের মতে, তাঁর কট্টর মমতা-বিরোধী রাজনীতিই দলকে এ রাজ্যে আরও কোণঠাসা করে দিয়েছে। তাঁরা মনে করেন, রাজ্যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া বামেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেসের টিকে থাকা সম্ভব নয়। বরং মমতার সঙ্গে জোট করলে অধীরকে হারতে হত না। নতুন প্রদেশ সভাপতি শুভঙ্কর এখনও বলার মতো জোট-অঙ্কের দরকারের সামনে পড়েননি। তবে সম্প্রতি ছয় বিধানসভার যে উপনির্বাচন হল, তাতে বাম আর কংগ্রেস আলাদা ভাবেই লড়েছে। জোট হয়নি।

প্রদীপের বক্তব্য কি মমতার প্রতি প্রদেশ কংগ্রেসের নতুন নেতৃত্বের মতামতের প্রতিফলন? উত্তর স্পষ্ট নয় এখনও। তবে, দেরিতে হলেও প্রদীপের ‘বোধোদয়ে’ খুশি তৃণমূল। ১৯৯৭ সালে মমতার সঙ্গেই কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘সেই সময়ে মমতাকে বহিষ্কার করে মস্ত ভুল করেছিল কংগ্রেস। সিপিএমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইতেন মমতা। প্রদেশ কংগ্রেস থেকে তাঁকে সাহায্য করত না। মমতা প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। দেরিতে হলেও যে প্রদীপ ভুল বুঝতে পেরেছেন, তাতে ভাল লাগছে।’’

ঘটনাচক্রে, যে সোমেনের মূর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে প্রদীপের মমতা-আক্ষেপ, যে সোমেন প্রদেশ সভাপতি থাকাকালীন কংগ্রেস থেকে মমতাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, কংগ্রেসে থাকাকালীন যে সোমেনের সঙ্গে মমতার বিরোধ বহু চর্চিত, সেই সোমেনও এক সময় মমতার হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা তুলে নিয়েছিলেন। তৃণমূলের টিকিটেই তিনি জীবনে প্রথম বার সাংসদ হন ডায়মন্ড হারবারে জিতে। পরে অবশ্য তৃণমূল ছেড়ে আবার তিনি কংগ্রেসে ফিরে যান।

Advertisement
আরও পড়ুন