গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
মেদিনীপুর মেডিক্যালে এক প্রসূতির মৃত্যু ও আরও চার জনের অসুস্থতার নেপথ্যে ‘চিকিৎসা গাফিলতি’-কেই প্রাথমিক কারণ হিসেবে দাবি করেছে রাজ্য। অভিযোগ, সিনিয়র চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (পিজিটি)-রা অস্ত্রোপচার করায় কিছু ত্রুটি থাকে, তাতে প্রসূতিদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তাতেই আপত্তি রাজ্যের বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন থেকে একাধিক সিনিয়র চিকিৎসকদের। তাঁদের দাবি, ‘‘প্রকৃত কারণকে ধামাচাপা দিতেই, চিকিৎসকদের উপর খাঁড়া নামানো হচ্ছে।’’
অভিযোগ উঠেছে, পাঁচ প্রসূতির অস্ত্রোপচার করেছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যালের স্ত্রী-রোগ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (পিজিটি)। অ্যানাস্থেশিয়া দিয়েছিলেন প্রথম বর্ষের পিজিটিরা। গোটা প্রক্রিয়ায় দুই বিভাগেরই কোনও সিনিয়র চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন না। প্রসূতি মৃত্যু ও অসুস্থতার ঘটনার তদন্তে স্বাস্থ্য দফতরের গঠিত বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও এর উল্লেখ রয়েছে বলে খবর। ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ (আরএল) স্যালাইন, ‘অক্সিটোসিন’ ইঞ্জেকশন ব্যবহারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া, না কি চিকিৎসকদের ত্রুটিতে পাঁচ প্রসূতির এমন পরিণতি— সেই বিতর্কের মাঝেই সোমবার একটি নির্দেশিকা জারি করে মেদিনীপুর মেডিক্যালের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, পিজিটি-রা কোনও অস্ত্রোপচার এবং অ্যানাস্থেশিয়ার প্রক্রিয়া করতে পারবেন না। সেই কাজ করবেন একমাত্র সিনিয়র চিকিৎসকেরা, যাঁদের এমডি-এমএস ডিগ্রি রয়েছে। কোনও পিজিটি যদি নিজে সেই সমস্ত কাজ করেন, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
ওই হাসপাতালের এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই ওই নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। সিনিয়র চিকিৎসকদের উপস্থিতি ছাড়া পিজিটি-রা অস্ত্রোপচার করতে পারেন না, সেটাই মনে করানো হয়েছে।’’ যদিও নির্দেশিকার বয়ান সেই কথা বলছে না। তাই ওই নির্দেশিকা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন প্রাক্তন ও বর্তমান সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁরা জানাচ্ছেন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের (এনএমসি) গাইডলাইন বা নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা আছে, পিজিটি-রাকতগুলি অস্ত্রোপচারে সহকারী হিসেবে থেকেছেন অথবা নিজে করেছেন, তা ‘ই-লগ বুক’-এ নথিভুক্ত করতে হবে। এক সিনিয়র চিকিৎসক রেজাউল করিম বলেন, ‘‘এই ফরমানে এটা স্পষ্ট হল না যে, পিজিটি-রা ওষুধপত্র লিখতে পারবেন কি না। অবশ্যই একজন শিক্ষক-চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে তাঁরা চিকিৎসা করেন, হাতেকলমে অস্ত্রোপচার শিখে ধীরে ধীরে দক্ষতা অর্জন করেন। দীর্ঘকাল ধরে এটাই হয়ে আসছে। কিন্তু এই নির্দেশিকা অনুযায়ী সেটি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে ভবিষ্যতে ইউটিউব দেখে অস্ত্রোপচার শিখতে হবে।’’
সিনিয়র চিকিৎসকদের অনেকে এটাও বলছেন, চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় যাঁদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তাঁরা জানেন, রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলি চলে পিজিটি-দের উপর ভরসা করেই। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের কর্মবিরতে পরিষেবা যে কতটা অচল হতে পারে, তা-ও দেখা গিয়েছে। মঙ্গলবার এক সাংবাদিক বৈঠকে জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের তরফে দেবাশিস হালদার বলেন, ‘‘মেদিনীপুর মেডিক্যালের নির্দেশিকা হাস্যকর। সিনিয়রদের তত্ত্বাবধানে পিজিটি-দের অস্ত্রোপচার করতে হবে— এটা বলা উচিত ছিল। কিন্তু ওই নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, সিনিয়র চিকিৎসকদেরই অস্ত্রোপচার করতে হবে। তা হলে ‘এনএমসি’-র যে গাইডলাইন আছে, তার কী হবে?’’ দেবাশিস আরও বলেন, ‘‘আর জি কর কাণ্ডের প্রেক্ষিতে আন্দোলনের সময়ে বার বার পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগের দাবি তুলেছিলাম। সব অস্ত্রোপচার ও অ্যানাস্থেশিয়া প্রক্রিয়া করার মতো পর্যাপ্ত সিনিয়র চিকিৎসকই তো নেই। প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে দৈনিক কত অস্ত্রোপচার হয়, তা প্রশাসনিক কর্তারা জানেন?’’
মেদিনীপুরের ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত তাঁরাও চান বলে এ দিন দাবি করেছেন ফ্রন্টের সদস্য আশফাকউল্লা নাইয়া, বিপ্রেশ চক্রবর্তীরা। তাঁদের কথায়, ‘‘আরএল-নিয়ে সমস্যা অনেক দিন ধরেই। ওই স্যালাইন দেওয়ার পরেই রোগীর জ্বর, কাঁপুনি শুরু হতে দেখে, তা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। এত বার এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় যে, জুনিয়র চিকিৎসকেরা এর নাম ‘রাইগর ল্যাকটেট’ দিয়েছিলেন। অনেক হাসপাতালেই দীর্ঘ দিন ধরে জুনিয়র চিকিৎসকেরা ওই স্যালাইন ব্যবহার করতেন না।’’ তাই, শুধু চিকিৎসকদের উপরে দায় না চাপিয়ে নিম্ন মানের স্যালাইন ও ইঞ্জেকশনের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে জানান ফ্রন্টের সদস্যরা। কেন এত দিন তা হয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণ দাবি করেন তাঁরা। তাঁদের কথায়, ‘‘প্রশ্ন করলেই মোড় ঘোরানোর চেষ্টা কেন? স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে কোথায় কী ফাঁক রয়েছে, তা জানতে সরকার দ্রুত আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন বলেই আশা রাখছি।’’
এসএসকেএম ভর্তি নাসরিন খাতুন, মাম্পি সিংহ ও মিনারা বিবি সঙ্কটজনক। নাসরিনকে ভেন্টিলেশন থেকে কিছু ক্ষণ বার করে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে।
মেদিনীপুরের ঘটনার প্রতিবাদে এ দিন স্বাস্থ্য ভবনের সামনে পূর্ণাঙ্গ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে বিক্ষোভ দেখায় ‘সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম’, ‘মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টার’ ও ‘নার্সেস ইউনিটি’। বিক্ষোভকারী চিকিৎসক ও নার্সেরা দাবি করেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল যে নির্দেশিকা জারি করেছে, তা বাতিল করতে হবে। কারণ, রাজ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষক-চিকিৎসকের পদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। সেই জায়গায় পিজিটি-রা অস্ত্রোপচার না করলে পরিষেবা মারাত্মক ধাক্কা খাবে। ‘চিকিৎসা গাফিলতি’-কে শিখণ্ডি খাড়া করে ওষুধ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামগ্রিক দুর্নীতির মাথাদের আড়াল করার চেষ্টার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টর্স’-র তরফে প্রয়োজনে সাধারণ মানুষকে নিয়ে আবারও সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
মেদিনীপুর মেডিক্যালের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। যদিও মৃত প্রসূতি মামনি রুইদাসের পরিবার সিবিআই-তদন্তের পক্ষপাতী। একই দাবি বিজেপিরও। সিবিআই তদন্ত চেয়ে কেন্দ্রের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জে পি নড্ডাকে এ দিন চিঠি দিয়েছেন পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো। রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য রাজ্যের নিজস্ব বিষয়। তাই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়ে কোনও লাভ নেই, সেটা সাংসদের জানা উচিত। বলতে হলে তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে বলতে হবে। আর, এখানে তো সিবিআই অনেক হল, কিন্তু ফল কী হল? সিআইডি তো তদন্ত করছে।’’
বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীর বলেন, ‘‘গর্হিত অপরাধ। হত্যার মামলা হওয়া উচিত রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের বিরুদ্ধে।’’ পাল্টা চন্দ্রিমার বক্তব্য, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নিয়ে বিরোধী দলনেতার রাজনীতি মানায় না। কিছু দিন আগে উত্তরপ্রদেশে অনেক বাচ্চা মারা গিয়েছে। সেখানে কি উনি খুনের মামলা করেছেন? এখানে বসেই তো করতে পারতেন।’’