RG Kar Medical College And Hospital Incident

মোড়ক পাল্টে ওষুধ দুর্নীতি-যোগ আর জি করে

তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ওষুধের ব্যাচ নম্বরেও কারচুপি করে কাঁচামাল কেনার ভুয়ো নথি তৈরি করা হচ্ছে। এবং এটুকু রদবদলের জোরেই পুরনো, মেয়াদ উত্তীর্ণ বাতিল ওষুধ নতুন মোড়কে ভরে আনকোরা তাজা ওষুধ বলে বাজারে পেশ করা হচ্ছে।

Advertisement
শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:২৮

— প্রতীকী চিত্র।

নতুন করে ওষুধ তৈরির খরচের ধাক্কা বা ঝক্কি নেই। একটি ছোটখাটো ডেরায় দরকার, বড়জোর কালি মোছার রাসায়নিক। কিংবা নতুন করে মোড়কের গায়ের লেখা ছাপার আধুনিক সরঞ্জাম। ব্যস, তাতেই কেল্লা ফতে! মাত্র জনা দশেকের লোকবলেই মেয়াদ উত্তীর্ণ কয়েক লক্ষ ওষুধের পুরনো ব্যাচ নম্বর বা ফুরান তারিখের কালি মুছে মোড়কের ভোল পাল্টে ফেলা হচ্ছে বলে সিবিআই তদন্তে উঠে আসছে। ক্যাপসুল, ট্যাবলেটের মোড়ক বা তরল ওষুধের বোতলে সাঁটা কাগজেও এমন পরিবর্তন করা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।

Advertisement

তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ওষুধের ব্যাচ নম্বরেও কারচুপি করে কাঁচামাল কেনার ভুয়ো নথি তৈরি করা হচ্ছে। এবং এটুকু রদবদলের জোরেই পুরনো, মেয়াদ উত্তীর্ণ বাতিল ওষুধ নতুন মোড়কে ভরে আনকোরা তাজা ওষুধ বলে বাজারে পেশ করা হচ্ছে।

আর জি করের আর্থিক দুর্নীতিতে ধৃতেরা কলকাতায় একাধিক সরকারি হাসপাতালে নিম্নমানের বা বাতিল ওষুধ সরবরাহ করত বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। সব মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার ওষুধ দুর্নীতি জাঁকিয়ে বসেছে বলে সিবিআইয়ের তদন্ত সূত্রে উঠে এসেছে। তদন্তকারীদের দাবি, গোটা দেশেই ওষুধ বাজারে অন্তত ৩০ শতাংশ ওষুধ ব্যবহারের আগেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। দুর্নীতিতে সস্তায় বাজিমাতের লক্ষে সেই পুরনো ওষুধই নিশানা করে থাকে জালিয়াতেরা। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, "এ রাজ্য এখন মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধের প্রায় ৯০ শতাংশই নষ্ট করা হয় না। আর সেখান থেকেই দুর্নীতি চক্রেরসূত্রপাত। তা ছাড়া আশপাশের ভিন রাজ্য থেকেও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এবং তার মোড়কেও ব্যাচ নম্বর ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ বদল করা হচ্ছে বলে প্রাথমিক ভাবে নানা সূত্র পাওয়া গিয়েছে।’’ সিবিআইয়ের এক কর্তার দাবি, "এ একেবারে সংঘটিত অপরাধ। জাল ওষুধের কারবারের সঙ্গে প্রভাবশালীরাও অনেকে জড়িত। তা না-হলে বড় হাসপাতালে জাল ওষুধ কারবারিরা ঢুকতে পারত না!’’

তদন্তকারীদের কথায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ফেরত নেয় না। আর ওই সুযোগই তৈরি হয়েছে বৃহত্তর দুর্নীতি চক্র। ওই চক্রের পান্ডারা বাজারে পাইকারি ও খুচরো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ওই সব মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ওষুধ মূল দামের পাঁচ থেকে সাত শতাংশ দামেই কিনে নিচ্ছে। তার পর মোড়কে ব্যাচ নম্বর ও ফুরান তারিখ পাল্টে সেই ওষুধ নতুন বলে ফের বাজারে পেশ করা যেন জলবৎ তরল।’’ সিবিআইয়ের তদন্তে উঠে আসা তথ্যের সঙ্গে সহমত অল ইন্ডিয়া কেমিস্ট অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটারশিপ ফেডারেশনের সম্পাদক জয়দীপ সরকার। তিনি বলেন, "এটা নতুন কিছু নয়। সারা দেশেই কিছু দুষ্কৃতী চক্র এমন ভাবেঅল্প-স্বল্প জাল ওষুধ তৈরি করত। কিন্তু এখন এটাই এ রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সিবিআইয়ের উচিত সমস্ত তদন্ত প্রকাশ্যে নিয়ে আসা।’’

আর জি করের আর্থিক দুর্নীতির মামলায় প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ঘনিষ্ঠ দুই ওষুধ ব্যবসায়ী সুমন হাজরা এবং বিপ্লব সিংহ জেল হেফাজতে রয়েছেন। সিবিআই হেফাজতে থাকাকালীন তাঁদের জেরা এবং দুর্নীতির সমস্ত বিষয় তদন্ত করা হয়েছে। শুধু মাত্র আর জি কর নয়। কলকাতার একাধিক সরকারি হাসপাতালে সুমন ও বিপ্লব নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ করতেন বলে তদন্তে সূত্র পাওয়া গিয়েছে। তদন্তকারীদের দাবি, ওই দু'জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিম্নমানের ওষুধ তৈরির চক্রের সিন্ডিকেটের হদিস পাওয়া গিয়েছিল। এবং পর্দার আড়াল থেকেপ্রভাবশালীদের নানা দুর্নীতির কোটি কোটি কালো টাকা কী ভাবে বেআইনি ওষুধ চক্রে সাদা করা হয়েছে প্রাথমিক ভাবে তারও নানা তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। ওই সব তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তের ধাপে ধাপে অগ্রগতি হচ্ছে বলে দাবি করছেনসিবিআইয়ের কর্তারা।

তদন্তকারীদের কথায়, ‘‘অতি প্রভাবশালীদের যোগসাজশে সরকারি হাসপাতালের একাংশই ওই ভুয়ো ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে সব থেকে নিরাপদ স্থান হয়ে উঠেছে। টেন্ডার দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে ওই ওষুধসরবরাহ করা হচ্ছে। প্রভাবশালী যোগ থাকাতেই সব রকম নজরদারি এড়িয়ে টেন্ডার দুর্নীতির মাধ্যমেঅতি সহজেই ওই সব ওষুধ সরবরাহ করা যাচ্ছে।’’

সিবিআই সূত্রে দাবি, আর জি করের আর্থিক দুর্নীতির মামলায় ধৃত প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা-সুদ্ধ পাঁচ জনের নামে সপ্তাহখানেকের মধ্যে আদালতে চার্জশিট পেশ করা হবে। চার্জশিটে দুর্নীতিতে সন্দীপঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের কয়েকটি সংস্থার ভূমিকার কথাও বলা হবে। এবং পরবর্তী সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটগুলিতে ধাপে ধাপে এই দুর্নীতিচক্রের বিচিত্র ডালপালা স্পষ্ট হতে থাকবে বলেই তদন্তকারীদের একাংশের দাবি।

আরও পড়ুন
Advertisement