গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গত বিধানসভা ভোটে ২০০ পারের স্লোগান দিয়ে ৭৭-এ থেমে গিয়েছিল বিজেপির রথ। তিন বছরের মাথায় সেই সংখ্যা কমতে কমতে ঠেকেছিল ৭৪-এ। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পর সেই সংখ্যা ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়েই উপনির্বাচনে নেমেছিল পদ্মশিবির। সেই সুযোগও ছিল। উপনির্বাচন হওয়া রাজ্যের চার বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে লোকসভার ফলাফলের নিরিখে তিনটি কেন্দ্রেই এগিয়ে ছিল পদ্মশিবির। কিন্তু উপনির্বাচনে তা-ও হারাল তারা। চারটি আসনেই জিতল শাসক তৃণমূল। ফলে বিধানসভায় শক্তি আরও কমল পদ্মশিবিরের। দলের বিধায়ক সংখ্যা ৭৪ থেকে কমে হয়ে গেল ৭১। তবে দলবদলের হিসাব ধরলে সেই সংখ্যাটা আরও কম। কারণ, গত তিন বছরে বিজেপির টিকিটে জেতা বেশ কয়েক জন বিধায়ক যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে।
চারটি আসনেই জেতার পর মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘অনেক চক্রান্ত হয়েছিল। এক দিকে এজেন্সি, এক দিকে বিজেপি। মানুষই সব রুখে দিচ্ছেন। পুরো কৃতিত্বটাই সাধারণ মানুষের।’’ শনিবার বিকেলেই মুম্বই থেকে কলকাতায় ফিরেছেন মমতা। কলকাতা বিমানবন্দরে তিনি বলেন, ‘‘সামাজিক দায়বদ্ধতা বেড়ে গেল। আমাদের আরও বেশি করে মানুষের পাশে থাকতে হবে। সারা ভারতেই আমি শুনেছি বিজেপি পর্যুদস্ত হয়েছে। গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী মনোভাব দেখা যাচ্ছে।’’
উপনির্বাচনে এই ভরাডুবিকে ‘সাংগঠনিক অক্ষমতা’ হিসাবেই দেখছে বিজেপি। দলের মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে শাসকদলের বিরুদ্ধে ভোটে লড়াই করার মতো সংগঠন বিজেপির নেই। এটা স্বীকার করতে আমাদের লজ্জা নেই। আমরা পারিনি সে ধরনের সংগঠন তৈরি করতে। এটা আমাদের ব্যর্থতা।’’
শনিবার রাজ্যের চার কেন্দ্র— মানিকতলা, বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ ও রায়গঞ্জে উপনির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের নিরিখে মানিকতলা বাদে বাকি তিন আসনে জিতেছিল বিজেপি। পরে সেই বিধায়কেরা দলবদল করলেও খাতায়কলমে ওই তিনটি আসন বিজেপিরই ছিল। উপনির্বাচনে সেগুলিও দখল করল তৃণমূল। গত বিধানসভা ভোটে বাগদায় বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন বিশ্বজিৎ দাস। পরে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। গত লোকসভা ভোটে তাঁকে বনগাঁ কেন্দ্রে শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রার্থী করে শাসকদল। যে কারণে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। তিনি লোকসভা ভোটে হারায় বাগদায় উপনির্বাচন হয়। বাগদায় এ বার বিশ্বজিৎ দাঁড়াতে না চাওয়ায় তৃণমূল প্রার্থী করে দলের রাজ্যসভা সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের কন্যা মধুপর্ণা ঠাকুরকে। মধুপর্ণা ৩৩ হাজারেরও বেশি ভোটে হারিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী বিনয়কুমার বিশ্বাসকে। উপনির্বাচনে জিতে বিধানসভার সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক হলেন তিনি।
বাগদার মতো একই কারণেই উপনির্বাচন হয়েছে রানাঘাট দক্ষিণ এবং রায়গঞ্জে। নদিয়ার রানাঘাট দক্ষিণ কেন্দ্রে জিতেছেন মুকুটমণি অধিকারী। রায়গঞ্জে কৃষ্ণ কল্যাণী। গত বিধানসভা ভোটে বিজেপির টিকিটে এই রানাঘাট দক্ষিণেই জিতেছিলেন মুকুটমণি। লোকসভা ভোটের আগে তিনি যোগ দেন শাসকদলে। রানাঘাটে বিজেপির জগন্নাথ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রার্থীও করে তৃণমূল। মুকুটমণি জিততে পারেননি। এ বার তিনি রানাঘাট দক্ষিণ কেন্দ্রে জিতলেন তৃণমূলের টিকিটে। বিজেপি প্রার্থীকে হারালেন ৩৯ হাজার ভোটে। কৃষ্ণও গত বার বিজেপির টিকিটে জিতে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। বিশ্বজিৎ, মুকুটের মতো তাঁকে লোকসভায় প্রার্থী করেছিল শাসকদল। তিনিও হেরেছিলেন। সেই কৃষ্ণই তৃণমূলের প্রতীকে জিতলেন এ বার। রায়গঞ্জে বিজেপি প্রার্থীকে হারালেন ৫০ হাজারেরও বেশি ভোটে।
মানিকতলায় রেকর্ড ভোটে জিতেছে তৃণমূল। গত বিধানসভায় সাধন পাণ্ডে এই কেন্দ্রে ২০ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বিধায়কশূন্য হয়ে পড়েছিল মানিকতলা। আদালতে মামলার জেরে উপনির্বাচনও আটকে ছিল। সম্প্রতি মামলার নিষ্পত্তি হওয়ায় উপনির্বাচন হল। সেখানে জিতলেন সাধনেরই স্ত্রী সুপ্তি পাণ্ডে। গত লোকসভা ভোটে উত্তর কলকাতায় তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ে মানিকতলার ভূমিকা ‘নগণ্য’ই ছিল। মাত্র সাড়ে তিন হাজার ভোটের ‘লিড’ ছিল। তা বেড়ে হল ৬২ হাজারেরও বেশি!
তবে ‘ব্যর্থতা’ মেনে নিয়েও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট লুটের অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। শমীকের বক্তব্য, বাগদা ও রানাঘাট দক্ষিণে মানুষকে জোর করে, ভয় দেখিয়ে শাসকের পক্ষে ভোট দেওয়ানো হয়েছে। তবে উপনির্বাচনের ফলাফলে যে যথেষ্ট চিন্তার বিষয় রয়েছে, তা-ও শমীকের বক্তব্যে ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, ‘‘উপনির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে শাসকদলেরই জয় হয়। এটাই এ রাজ্যের ট্র্যাডিশন। কিন্তু বাগদা ও রানাঘাট দক্ষিণে যে ব্যবধানে পরাজয় হয়েছে, তা অন্তর্তদন্তের বিষয়। দল বিষয়টি দেখবে। আলোচনা হবে। বিজেপি এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াবে।’’
বিজেপি নেতৃত্ব ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বললেও জেতা আসনে এ ভাবে হেরে যাওয়া এবং লাগাতার বিধায়ক সংখ্যা কমতে থাকার বিষয়টি যে যথেষ্ট চিন্তার, তা একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন দলের নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, উপনির্বাচনের ফল শাসকদলের পক্ষে যাওয়া ‘দস্তুর’ হলেও তার ব্যতিক্রম রয়েছে। সাগরদিঘি উপনির্বাচনেই তা ঘটেছিল। শাসকদলের হাত থেকে ওই আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছিল বাম-কংগ্রেস জোট। যদিও পরে সাগরদিঘিতে জেতা বাইরন বিশ্বাস তৃণমূলে যোগ দেন। কংগ্রেস পারলেও ২০২১ সালের পর যতগুলি উপনির্বাচন হয়েছে রাজ্যে তার একটিতেও জিততে পারেনি বিজেপি। গত বিধানসভা ভোটের পর পরেই বিজেপির দখলে থাকা শান্তিপুর ও দিনহাটা আসন উপনির্বাচনে জিতে নেয় তৃণমূল। এর পর লোকসভা ভোটের আগে ধূপগুড়ি বিধানসভাও উপনির্বাচনে তৃণমূলের দখলে চলে যায়। বিজেপি নেতাদের একাংশ মনে করছেন, এ বারের উপনির্বাচনে এগিয়ে থাকা তিন আসনে জয় এলে লোকসভা ভোটে ভরাডুবির ‘ব্যথা’ খানিকটা হলেও লাঘব হত। আগামী বিধানসভার জন্য দলীয় কর্মীদের মনোবলও চাঙ্গা করা যেত। কিন্তু সেই সুযোগ নষ্ট হল। বিজেপির এক রাজ্য নেতার আশঙ্কা, ‘‘এ ভাবে একের পর এক ভোটে হারতে থাকলে আগামী দিনে দলে আরও ‘রক্তক্ষরণ’ হবে!’’
রক্তক্ষরণের সূত্রপাত হয়েছিল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর পরেই। মুকুল রায়ের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন দিয়ে। ওই বছরেই তৃণমূলে ফিরে যান বিষ্ণুপুরের বিজেপি বিধায়ক তন্ময় ঘোষও। এর পর একে একে বাগদার বিশ্বজিৎ, রায়গঞ্জের কৃষ্ণ ও কালিয়াগঞ্জের সৌমেন রায়, আলিপুদুয়ারের সুমন কাঞ্জিলাল যোগ দেন শাসকদলে। অর্থাৎ, খাতায়কলমে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ৭১ হলেও বাস্তবে দলের পক্ষে থাকা বিধায়কের সংখ্যা অনেকটাই কম। যা দলীয় নেতৃত্বের কাছে যথেষ্ট অস্বস্তির বলেই মনে করছেন অনেকে।
(এই খবরটি প্রথম প্রকাশের সময়ে সঙ্গের গ্রাফিকে জয়ী প্রার্থীদের প্রতীক যথাযথ ছিল না। কয়েকটি জায়গায় বিজেপির পরিবর্তে তৃণমূল এবং তৃণমূলের পরিবর্তে বিজেপির প্রতীক ছিল। নতুন গ্রাফিকে আমরা সেই ভ্রম সংশোধন করেছি। অনিচ্ছাকৃত ওই ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী)