TMC BJP

বাংলাদেশ নিয়ে বিজেপির হিন্দু মিছিলের পর ওয়াকফ নিয়ে মুসলিমদের সমাবেশ তৃণমূলের, স্পষ্ট ‘মেরুকরণ’

গত ১৩ বছরে বাংলার বিভিন্ন ভোটের ফলাফল সাদা চোখে দেখলে স্পষ্ট, রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটর প্রায় সবটাই রয়েছে তৃণমূলের দিকে। আবার ২০১৯ থেকে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে। কমেছে বামেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৯
BJP is sharpening Hindutva politics on Bangladesh incident, TMC gathers minorities to protest against Waqf Bill

বাংলাদেশ নিয়ে পথে বিজেপি। ওয়াকফ বিলের প্রতিবাদে সরব তৃণমূল। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফলই স্পষ্ট করে দিয়েছিল, বাংলার রাজনীতিতে ‘ধর্মীয় মেরুকরণ’ হয়েছে। তার পর থেকে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট এবং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে। গত তিন দিনে কলকাতা শহরে বিজেপি এবং তৃণমূলের কর্মসূচি দেখে রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করছেন, বঙ্গ রাজনীতি এই মেরুকরণের চক্রব্যূহে আটক। সেখান থেকে বার করার মতো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি মাথা তোলার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

Advertisement

বাংলাদেশে সন্ন্যাসী গ্রেফতারের ঘটনা নিয়ে বিজেপি রাস্তায় নেমেছে। বিজেপির পাশাপাশি ‘হিন্দু সংহতি মঞ্চ’ও গত বৃহস্পতিবার কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছিল। যে কর্মসূচি কোথাও কোথাও ‘আমিষ’ চেহারাও নিয়েছিল। সেই আবহেই শনিবার কেন্দ্রের ওয়াকফ সংশোধনী বিলের প্রতিবাদে রানি রাসমণি রোডে ‘সংখ্যালঘু সমাবেশ’ করল তৃণমূল। যা থেকে এটা স্পষ্ট যে মেরুকরণ বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। যদি না রাজনৈতিক পরিসরে ‘নাটকীয়’ কোনও পটপরিবর্তন ঘটে যায়।

গত সোমবার তৃণমূলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকেই ঠিক হয়েছিল যে, শনিবার সংখ্যালঘু সেলের ডাকে সভা হবে। সেই সভায় দেশের সংবিধান এবং ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো রক্ষার জন্য লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিমেরা। একই সঙ্গে তৃণমূলের সভায় জুড়ে গিয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও। ওপার বাংলায় যা চলছে তাকে ইতিমধ্যেই ‘দুর্ভাগ্যজনক এবং নিন্দনীয়’ বলেছেন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব এ-ও বলেছেন যে, অন্য দেশের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকার যে অবস্থান নেবে, সেটাই তৃণমূলের অবস্থান।

কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়াকফ সংশোধনী বিল কী? কেন তৃণমূলের বিরোধিতা?

ওয়াকফ সংশোধনী বিলের কয়েকটি বিষয় নিয়ে বাংলার শাসকদল আপত্তি জানিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল তিনটি। এক, সেখানে বলা হয়েছে, মৌখিক ভাবে যে সম্পত্তি ওয়াকফ হয়েছিল, তা অধিগৃহীত হবে। যাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মনে করে তৃণমূল। দ্বিতীয়ত, ওয়াকফ প্রদানকারী কেউ ধর্মীয় ভাবে মুসলিম কি না, তা নির্ধারিত হবে তাঁর ধর্মাচরণের অভ্যাস নিয়মিত কি না, তার উপর। বাংলার শাসকদলের বক্তব্য, এটিও ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর ‘আঘাত’। তিন, ওয়াকফ সম্পত্তি সমীক্ষার জন্য জেলাশাসকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলার শাসকদল মনে করে, এর ফলে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে টানাটানি করা হবে।

গত ১৩ বছরে বাংলার বিভিন্ন ভোটের ফলাফল সাদা চোখে দেখলেই স্পষ্ট, রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের প্রায় সবটাই রয়েছে তৃণমূলের দিকে। আবার ২০১৯ থেকে বামেদের ভোট বিজেপির বাক্সে যে ভাবে ঢেলে গিয়ে পড়েছিল, তা থেকে গিয়েছে। বামেদের দিকে থাকা সেই জনসমর্থনের বেশির ভাগটাই ছিল হিন্দু ভোট। যা চলে গিয়েছে পদ্মের দিকে। পর পর ভোটে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, বঙ্গ রাজনীতি দ্বিমেরু অক্ষেই আবর্তিত হচ্ছে। যে কারণে বিজেপি প্রাণপণ চেষ্টা করছে হিন্দু ভোটের পুরোটা তাদের দিকে টানতে।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি কিছু ঘটনায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, ‘‘এই অবস্থার জন্য শুধু প্রশাসন দায়ী নয়। তৃণমূলের সঙ্গে যে হিন্দুরা রয়েছেন, তাঁরাও সমান দায়ী।’’ রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, এই প্রশ্নে বিজেপির ‘অসুবিধা’ রয়েছে। কারণ, পদ্মশিবিরের হাতে মেরুকরণই ‘অস্ত্র’। কিন্তু তৃণমূল সংখ্যালঘু সমর্থন সংহত রেখে নিচুতলায় এমন একটি ‘অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্র’ তৈরি করতে পেরেছে, যেখানে ধর্মের চেয়ে পেটের তাগিদ মুখ্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিজেপি হিন্দু ভোটের পুরোটাই তাদের দিকে টেনে নিতে পারবে, তেমনটা হওয়া এখনই সম্ভব নয় বলেই বক্তব্য অনেকের। তবে মেরুকরণের আবহ যে রয়েছে, এবং সেখান থেকে যে বঙ্গ রাজনীতি বেরিয়ে আসতে পারবে না, তা-ও মেনে নিচ্ছেন অনেকে।

এ কথা ঠিক যে, বাংলায় বাম এবং কংগ্রেস ধর্মীয় মেরুকরণের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক ভাবে রুটি-রুজির কথা তুলছে। কিন্তু ধারাবাহিক ভোটের ফল স্পষ্ট করে দিচ্ছে, বাম-কংগ্রেসের সেই বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করছেন না। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অন্যায় হচ্ছে। আমাদের দেশেও হচ্ছে। দুটোই অন্যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, তা নিয়ে মেরুকরণ জিইয়ে রাখতে চাইছে তৃণমূল এবং বিজেপি।’’ উল্লেখ্য, ওয়াকফ নিয়ে তৃণমূল যখন সমাবেশ করে সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করছে, তখন বিজেপির বক্তব্য, এই রাজ্যে হিন্দুরা ‘বিপন্ন’। পাল্টা ফিরহাদ বলেছেন, ‘‘যখন প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা দিতে হয় যে, আমি ভারতীয় কি না, তখন নিজেকে হেয় মনে হয়।’’

অর্থাৎ, মেরুকরণই বঙ্গ রাজনীতির ‘বর্তমান’। নাটকীয় কিছু না ঘটে গেলে সেটিই ‘ভবিষ্যৎ’।

আরও পড়ুন
Advertisement