(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
হলদি নদীর তীরে এক সময়ে তাঁদের যুগলবন্দিতে জমি নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন দেখেছিল বাংলা। হলদি নদীর তীরে সেই দু’জনের দ্বৈরথও চাক্ষুষ করেছে রাজ্য রাজনীতি। সেই দু’জনের এক জন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য জন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
যে নন্দীগ্রামে তাঁরা আন্দোলন করেছিলেন, সেই নন্দীগ্রামই তাঁদের মধ্যে বৈরিতার বীজ বপন করে দিয়েছিল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে। মুখোমুখি লড়াই। যে নির্বাচনের ফল মমতা পরাস্ত হয়েছেন শুভেন্দুর কাছে। যদিও সেই বিষয়টি এখনও আদালতে বিচারাধীন। সেই আবহে সন্দেশখালি-পর্বে এবং লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে দু’জনের সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত থেকে তিক্ততর জায়গায় পৌঁছচ্ছে বলেই দুই যুযুধান শিবিরের অনেকে মনে করছেন। বস্তুত, ওয়াকিবহাল মহলের এ-ও বক্তব্য, মমতা-শুভেন্দু সম্পর্ক যে জায়গায় পৌঁছেছে বা লোকসভা ভোটের অব্যবহিত আগে যে জায়গায় পৌঁছতে পারে, তা বাংলার গণতন্ত্রে নজিরবিহীন।
কয়েক দিন আগে শুভেন্দু যে ভাষায় মমতাকে আক্রমণ করেছিলেন, তাতে অনেকে সিপিএমের সুর শুনতে পেয়েছিলেন। শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘‘সিঙ্গুরে মমতাকে হাইওয়েতে বসতে দেওয়া ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের মস্ত বড় ভুল। সে দিন যদি চুলের মুঠি ধরে তুলে দিত, তা হলে বাংলার এত বড় সর্বনাশটা হত না।’’ এই ভাষায় সিপিএমের অনিল বসু, গৌতম দেবরা এক সময় মমতাকে আক্রমণ করতেন। আবার বুধবার বাঁকুড়ার খাতড়ার প্রশাসনিক সভা থেকে মমতা বলেছেন, ‘‘যারা যারা বড় কথা বলে বেড়াচ্ছে, ... খুলব ভান্ডার? ভান্ডারে আমার অনেক কিছু জমা আছে কিন্তু। আস্তে আস্তে ভান্ডারটা যখন খুলব না, তখন বুঝতে পারবেন কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল!’’ যাতে হুঁশিয়ারির সুর স্পষ্ট। কিছু দিন আগে মমতা এ-ও বলেছিলেন, ‘‘আমি কি পারি না গদ্দারদের (তৃণমূলের প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু দল বদলে বিজেপিতে যাওয়ার পর থেকে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে ‘গদ্দার’ বলে সম্বোধন করতে শোনা গিয়েছে মমতাকে) গ্রেফতার করতে? একটু সময় দিচ্ছি। সুতো ছাড়ছি।’’
বস্তুত, রাজনীতিতে রাজনৈতিক আক্রমণ থাকে। কিন্তু সেই আক্রমণের ভাষা, শব্দ ইত্যাদি সূচকে অনেকেই পরস্পরের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে দাঁড়িপাল্লায় মাপতে চান। শুভেন্দু এবং মমতা একে অন্যের প্রতি যে সমস্ত ভাষা ব্যবহার করছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। যা লোকসভার আগে তিক্ততর হওয়ার নির্দিষ্ট সম্ভাবনা।
বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে জ্যোতি বসুর সম্পর্ক কেমন ছিল তা সর্বজনবিদিত। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সঙ্গেও জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক সম্পর্ক যা-ই থাক, ব্যক্তিগত সখ্য ছিল। দু’জনে একসঙ্গে পড়াশোনাও করেছিলেন বিলেতে। তার পর সময় এগিয়েছে। জ্যোতিবাবুর সঙ্গে বিরোধী দলনেতাদের এই রকম তিক্ত সম্পর্ক ছিল না। তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর জ্যোতিবাবু বা বুদ্ধদেবের সঙ্গে পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়দেরও রাজনৈতিক লড়াই থাকলেও সম্পর্ক তিক্ত হয়নি। উল্টে রাজনীতির রীতি মেনে অন্তরালে একটা সমন্বয় চালু থাকত। সিঙ্গুর-পর্বে পার্থই ছিলেন সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রাখতে মমতার দূত। তথ্যকেন্দ্রের বৈঠক, রাজভবনের বৈঠক— সবেতেই পার্থের ভূমিকা ছিল বিরোধী দলনেতা হিসাবে। পরবর্তী কালে মমতা সরকারে আসার পর বিরোধী দলনেতা হিসাবে সূর্যকান্ত মিশ্র এবং তার পর কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানের সঙ্গে মমতার রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকলেও ব্যক্তিগত স্তরে সংঘাত ছিল না। সূর্যকান্ত সিপিএমের যে রাজ্য সম্মেলন থেকে রাজ্য সম্পাদক হয়েছিলেন, সে দিন তাঁর স্ত্রী ঊষা মিশ্রের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় হানা দিয়েছিল সিআইডি। সে দিনও রাজনৈতিক আক্রমণ বা পাল্টা জবাব মাত্রা ছাড়ায়নি।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে শুভেন্দু ছিলেন মমতার ‘আস্থাভাজন’। ধারাবাহিক ভাবে কৃষিজমি অধিকার রক্ষা কমিটির সঙ্গে সমন্বয় রাখা থেকে অন্যান্য পরিকল্পনা— সবই ছিল শুভেন্দুর। কারণ, নন্দীগ্রাম শুভেন্দুর ‘চেনা মাঠ’। তিনি কাঁথির ভূমিপুত্র। নন্দীগ্রামে ‘পরীক্ষিত’ শুভেন্দুকে লালগড়, নেতাইতেও ব্যবহার করেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। সাংসদ শুভেন্দুকে তুলে এনে বিধানসভায় লড়িয়ে ২০১৬ সালে রাজ্য মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছিলেন মমতা। সেই পর্ব থেকেই অবনিবনা শুরু হয় দু’জনের। কিন্তু তা যে এত দ্রুত এই পর্যায়ে পৌঁছবে, তা দুই শিবিরের অনেকেরই ধারণা ছিল না।
২০১৯ সালের নভেম্বরে ‘ভাইফোঁটা’র দিন প্রথম দিদির বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন শুভেন্দু। তার পরেই ছিল খড়্গপুর সদর বিধানসভার উপনির্বাচন, যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শুভন্দুকে। খড়্গপুর সদর আসনটি ছিল বিজেপির দখলে। শুভেন্দুর উপর দায়িত্ব ছিল সেই আসনটি ছিনিয়ে আনার। তার পর নভেম্বরে তা করতে পেরেছিলেন শুভেন্দু। বস্তুত, তৃণমূলে মমতার সঙ্গে ‘নৈকট্য’ বোঝার একটি সূচক তাঁর বাড়িতে ভাইফোঁটার নিমন্ত্রণ পাওয়া। তার এক বছরের মধ্যেই শুভেন্দুর সঙ্গে মমতা তথা তৃণমূলের সংঘাত এমন জায়গায় পৌঁছয় যে, শুভেন্দু মন্ত্রিসভা এবং দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। তার পরে নন্দীগ্রামের মাটিতেই ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি হন দু’জন। ১৯৫৬ ভোটের ব্যবধানে মমতাকে হারিয়েছিলেন শুভেন্দু। তার পরে মমতা ভবানীপুর বিধানসভা থেকে জিতে আসেন উপনির্বাচনে। যে কারণে শুভেন্দু মমতাকে কটাক্ষ করে ‘কম্পার্টমেন্টাল চিফ মিনিস্টার’। আবার মমতা মনে করেন, নন্দীগ্রামে গণনাকেন্দ্রে লোডশেডিং করে তাঁকে ‘জোর করে’ হারানো হয়েছিল। যে কারণে তৃণমূলের নেতারা আবার শুভেন্দুকে ‘লোডশেডিং অধিকারী’ বলে টিপ্পনি কাটেন। অনেকে বলেন, নন্দীগ্রামের ভোটের ফলাফলই দু’জনের বৈরিতা এবং তিক্ততার মূল কারণ।
তার পরের তিন বছরে জল অনেক গড়িয়েছে। শুভেন্দু যে যে শব্দে মমতাকে বেঁধেন, তা অনেক সময়ে শালীনতার ‘সীমা’ পেরিয়ে যায় বলে মনে করেন অনেকে। আবার তৃণমূলও শুভেন্দুকে আক্রমণ করতে গিয়ে তাঁর পরিবারকে জড়িয়ে ফেলে বার বার। সন্দেশখালি পর্বে তা সপ্তমে পৌঁছেছে। যাকে ‘মমতা জমানার নন্দীগ্রাম’ বলছেন শুভেন্দু। যে নন্দীগ্রামে ১৭ বছর আগে তাঁরা একসঙ্গে লড়েছিলেন।
(ভ্রম সংশোধন: এই প্রতিবেদনে প্রথমে লেখা হয়েছিল, ২০১৯ সালে খড়্গপুর উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির ভাইফোঁটায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু ভাইফোঁটা হয়েছিল ভোটের এক মাস আগে। শুভেন্দু ছিলেন খড়্গপুরের ভোটের দায়িত্বে। ভুলটি সংশোধন করা হল। ওই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।)