— প্রতীকী চিত্র।
বছর তেরোর এক কিশোরীর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল দাঁইহাটে। সে পড়াশোনা করার জন্য কাতর আবেদন করেছিল। পুলিশ ও চাইল্ড লাইন গিয়ে বিয়ে আটকে দেয়। এই ঘটনার কয়েক দিন পরে, কালনাতেও ১৪ বছরের এক কিশোরীর বিয়ে আটকায় পুলিশ ও চাইল্ডলাইন। এ ক্ষেত্রেও ওই কিশোরী বিয়েতে ‘না’ বলছে– ফোন পেয়েছিল চাইল্ড লাইন।
যদিও এই দু’টি ঘটনাকে ব্যতিক্রমী বলেই মনে করছেন শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা ও প্রশাসনের আধিকারিকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্টে যে তথ্য উঠে আসছে, তাতে নাবালিকা বিয়ের ‘খবর’ সময়ে সমাজকল্যাণ দফতর বা প্রশাসনের কাছে পৌঁছয় না। আবার, বিয়ে আটকানোর পরেও নজরদারির অভাবে কয়েক দিন পরে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার অভিযোগও কম নয়। তথ্য বলছে, পূর্ব বর্ধমানেই চলতি বছরে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ জন প্রসূতির মধ্যে এক জন নাবালিকা রয়েছেন। সেই হিসাবে, জেলায় ৬,২৭৮ জন নাবালিকা মা হয়েছে। তার মধ্যে ১৯৫ জনের বয়স ১৫ বছরের কম। সেখানে গত তিন বছরে জেলায় নাবালিকা বিয়ে আটকানো হয়েছে মোট ৪১১টি। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি বছর বিয়ে
আটকেছে মাত্র ১৩৭টি।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, পূর্ব বর্ধমানে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ২০৫টি বিয়ে আটকানো হয়েছিল। পরের অর্থবর্ষে (২৩-২৪) সেটা কমে হয় ১২৯। চলতি অর্থবর্ষে (২৪-২৫) অক্টোবর পর্যন্ত ৭৭টি বিয়ে আটকেছে সমাজকল্যাণ দফতর ও পুলিশ। বেশির ভাগ জনেরই বয়স ১৪-১৬ বছরের মধ্যে। বেশ কয়েক জন ১৩ বছরের নাবলিকাও রয়েছে। এ ছাড়া, ১৭ বছরের স্কুলছাত্রীও রয়েছে। নাবালিকা বিয়ের বেশি খবর মিলেছে ভাতার, মেমারি ১, বর্ধমান ১ ব্লক ও বর্ধমান পুরসভা এলাকায়।
যে জেলায় বিপুল সংখ্যায় নাবালিকা প্রসূতির খোঁজ পাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর, সেখানে নাবালিকা বিয়ের খবর সময়ে পাচ্ছে না কেন প্রশাসন? শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার দাবি, নাবালিকা প্রসূতি ও বিয়ে আটকানোর তথ্য দু’টির সারণিতে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, যে ব্লক থেকে বিয়ে আটকানোর খবর নেই বললেই চলে, সেখানে নাবালিকা প্রসূতি বেশি (যেমন কেতুগ্রাম ২)। আবার, এমন ব্লকও রয়েছে, যেখানে খবর বেশি মিললেও, নাবালিকা প্রসূতির হারও ভাল (যেমন, ভাতার)। ওই সংস্থার এক সুপারভাইজ়ারের দাবি, “বিয়ের খবর বিভিন্ন সংস্থার কাছে রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য পৌঁছয় না। পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের নাবালিকা বিয়ে রোধে যে ভূমিকা থাকা উচিত, অনেক ক্ষেত্রেই তা নেই। খবর দেওয়া তো দূরের কথা, বিয়ে যাতে না আটকায়, সে ব্যবস্থা করতেই বেশি উদ্যোগী হয়ে থাকেন অনেক জনপ্রতিনিধি।” একাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের দাবি, “নাবালিকা বিয়ে রোধে একটা উদ্যোগ ছিল। কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরাও খবর দিত। কিন্তু করোনা-কালের পর থেকে নাবালিকা বিয়েতে পঞ্চায়েতের লোকজন হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। তার পর থেকে খবরও কমতে থাকে।”
প্রশাসনের অনেকেই মনে করছেন, ১৮ বছর পর্যন্ত একটি মেয়ে পড়াশোনা করলে বিয়ের খরচ বা উচ্চ শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের চিন্তা করতে হচ্ছে না। সরকারের একাধিক প্রকল্প থেকে তাঁরা সাহায্য পান। কিন্তু সহজে হাতে ইন্টারনেট সংযোগ, মোবাইল পেয়ে যাওয়ায় সমাজ মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ হচ্ছে। অনেক আধিকারিকের অভিজ্ঞতা, সমাজ মাধ্যমে আলাপের পরে নাবালিকার কোনও ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে যথেষ্ট সংখ্যায়। পুলিশ জানাচ্ছে, নাবালিকা অপহরণ বা নিখোঁজের মামলাও বাড়ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার ভাবনা রয়েছে। সেখানে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সদস্য, কন্যাশ্রী ক্লাবের সঙ্গে স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরও যুক্ত করতে হবে। প্রশাসনের এক শীর্ষ আধিকারিক বলেন, “এখন পরীক্ষার মরসুম। তা পেরিয়ে গেলেই একেবারে নিচু স্তর পর্যন্ত সচেতন করার উপরে জোর দিতে হবে।”