Bardhaman

WB Municipal Election 2022: এক দিকে পুরনো শহরের সাবেকি ঢঙে ধ্বংসের চেহারা, আবার বহু জায়গায় গজিয়েছে বহুতল

বিগত পৌর ভোট হয়েছিল সেই ২০১৩ সালে। সে সময়ের ভোটের নিরিখে বর্ধমান পৌরসভার ৩৫টি ওয়ার্ড দখল করেছিল শাসকদল তৃণমূল।

Advertisement
শিবানন্দ পাল
শিবানন্দ পাল
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২১:১৬
শহরের যানজট

শহরের যানজট —নিজস্ব চিত্র।

বিগত দশকে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হয়েছিল। সাম্প্রতিক কয়েকটি পৌরসভার নির্বাচনে বিভিন্ন শহরে একাধিক ওয়ার্ডে বাম প্রার্থীরা হেরেছেন ১০০-র কম ভোটে। তাই এক সময়ে লালদুর্গ বলে পরিচিত বর্ধমান শহরের বামমনস্ক কিছু মানুষ উৎফুল্ল হয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ মনে করছেন রাজ্যে যেখানে সন্ত্রাসের হার কম সেখানে বামেদের ভোটের বিপুল বৃদ্ধি ঘটেছে, সুতরাং মানুষ ভোট দিতে পারলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারে।

বিগত পৌর ভোট হয়েছিল সেই ২০১৩ সালে। সে সময়ের ভোটের নিরিখে বর্ধমান পৌরসভার ৩৫টি ওয়ার্ড দখল করেছিল শাসকদল তৃণমূল। বামেরা দুপুরের আগেই প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ফল প্রকাশের পরে দেখা গিয়েছিল বাম এবং বিজেপি উভয়েই শূন্য। তবে ২০২১-র বিধানসভা ভোটের নিরিখে ৩৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল ১৮টিতে এবং বিজেপি ১৭টিতে এগিয়ে ছিল। বামেদের ঝুলি ছিল শূন্য। এই নিরিখে বিজেপিও এ বারে আশান্বিত। তবে এ বারের পৌরভোটের সৌরভ ফুটেছে তরুণ প্রার্থীদের জন্য। তৃণমূল, কংগ্রেস, বিজেপি এবং বাম— সব দলের প্রার্থীদের মধ্যে দেখা গেছে বেশির ভাগই তরুণ প্রার্থী। এই অবস্থায় প্রায় এক দশক পরে বর্ধমানে পৌরভোট হতে চলেছে, ফল কি দাঁড়াবে সময়ের অপেক্ষা।

Advertisement

ঐতিহাসিক শহর বর্ধমান, এই শহর আপনাকে স্বাগত জানায়! এমনই 'স্মারক' উজ্জ্বল নিয়ন আলোয় সজ্জিত হয়ে শহরের পূর্ব পশ্চিম প্রবেশ পথে মানুষকে জানায় অভ্যর্থনা। শহরের প্রবেশ পথ আধুনিক ঝকঝকে এবং বেশ চওড়াও বটে। প্রায় এক দশক রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে পৌর প্রশাসন শাসকদলের অধীনে পরিচালিত। ঐতিহাসিক কার্জন গেট নব কলেবরে সাজানো হয়েছে, হয়েছে ঘড়ি টাওয়ার এবং উচ্চ বাতিস্তম্ভ। আবার কোর্ট চত্বরে সবুজায়নের বিলুপ্তি ঘটিয়ে গড়ে উঠেছে বহুতলের প্রশাসনিক ভবন। শহরের গর্ব সাম্প্রতিক সময়ে রেল স্টেশন সংলগ্ন ওভারব্রিজ। দেখলে সত্যিই বর্ধমানবাসীর গর্ব হয়।

শহরের যান চলাচলে উন্নতি হয়েছে। দূরপাল্লার বাস এখন আর শহরের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত ত্রিকোনাপুকুর বাসস্ট্যান্ড বর্তমানে পরিত্যক্ত, লোকে এটি সমাজবিরোধীদের আড্ডাস্থল হিসেবেই জানে। সে জন্য শহরের বাইরে থেকে আসা মানুষের ক্ষোভ আছে এবং শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিশাল সমস্যাও তৈরি হয়েছে। গ্রাম দিয়ে ঘেরা ঐতিহাসিক শহর বর্ধমান। বিগত দশকগুলিতে লোকসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে। দিন দিন ওয়ার্ডের সংখ্যা বেড়েছে, পৌরসভার আয়তন বাড়লেও সেই তুলনায় পৌরসভার পরিষেবা পরিকাঠামোর উন্নতি হয়নি।

ফলে এক দিকে পুরনো শহরের সাবেকি ঢঙে ধ্বংসের চেহারা যেমন প্রকট হয়েছে, আবার জায়গায় জায়গায় বহুতল গজিয়ে উঠেছে। চকচকে ঝকঝকে বহুতলের চারপাশে ঘিঞ্জি জনপদ প্রকট হয়েছে। পৌরসভা লাগোয়া পঞ্চায়েত এলাকাগুলিতেও ঠাসাঠাসি মানুষের বাস। সেখানে পৌরসভার বিকল্প কোনও পরিষেবাই নেই, চাষের জমিতে অপরিকল্পিত বাড়িঘর তৈরি হয়েছে। প্রায় অর্ধ দশক পৌরসভার নির্বাচন বন্ধ ছিল, তাই বলে পৌরসভার কাজকর্ম বন্ধ ছিল না। প্রশাসক, আধিকারিকরা কোনও ভাবে কাজ চালিয়েছেন।

শিল্প শহর হিসেবে পরিচিত না হলেও গ্রামীণ শহর বর্ধমানে, গ্রামগঞ্জের উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত মানুষের সঙ্গে সঙ্গে কাজের সন্ধানে এই শহরে জড়ো হয়েছেন নানা কারণে কাজ হারানো অগুন্তি নিম্নবিত্ত মানুষ। শুধুমাত্র চিকিৎসা পরিষেবার প্রয়োজনে রেল, বাস ও অন্যান্য যানবাহন সহযোগে এই শহরে প্রবেশ করতে বাধ্য হন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, হুগলি এবং পশ্চিমবঙ্গের নিম্ন দামোদরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ অগুন্তি গরিব মানুষ। চিকিৎসা পরিষেবা সংক্রান্ত উপোযোগী নানাবিধ উপায়ে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করে থাকে এই শহর। এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে বা রোগীর পরিবার পরিজনদের সে কারণে একাধিক দিন শহরে বাস করতে হয়। বাড়তি শহরবাসীর এই সমস্যা বর্ধমান শহরে রাস্তা জ্যাম সহ পৌরসভার পরিকাঠামোতে বিশেষ বাড়তি চাপ তৈরি করে।

শহরের আয়তন সম্প্রসারণে নতুন নতুন এলাকাগুলিতে পরিকল্পনার ছাপ কোনও সময়েই ছিল না। সরু গলি রাস্তা, আবার গলি রাস্তাগুলি টোটো, মোটরসাইকেল ইত্যাদিতে পথচারী মানুষের বিপদ তৈরি করেছে। ঢালাই রাস্তা খোঁড়া হলে সঠিক ভাবে তার সারাই না হওয়া, নিকাশি ব্যবস্থার সমস্যা, ভ্যাট নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়া শহরকে নরককুণ্ডে পরিণত করে। শহরে পানীয় জলের সমস্যা তেমন প্রকট না হলেও নিকাশি ব্যবস্থা মাথাব্যথার কারণ। বিভিন্ন জায়গায় উন্নয়নের স্বার্থে নালার উপর ঢালাই বিকল্প রাস্তা তৈরি হয়েছে, আবার কোথাও বিশাল কাঁচা নর্দমার পাশে সরু কংক্রিটের রাস্তা তৈরি করে শহরের শোভা বর্ধন করা হয়েছে।

অধিকাংশ পুষ্করিণী, দিঘিগুলি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এই শহরের প্রধান ‌নিকাশি পথ পুব-পশ্চিমের বাঁকা নালা বা নদী এবং উত্তর দক্ষিণে প্রবাহিত বাদশাহি সড়কের সমান্তরাল খাল; যা রেলপথের নীচে দিয়ে গড়িয়ে আরও উত্তরে খড়ি নদীর সঙ্গে মিশেছে। কিন্তু কোথাও কোথাও বাঁকা নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির নামে উন্নয়ন ঘটানো হলেও বাঁকা নদী অধিকাংশ জায়গায় গরিব মানুষের জীবনধারণের মস্তবড় সাবেকি আশ্রয়স্থলের ভূমিকা পালন করে। আর বাদশাহি আমলের নয়নজুলির কথা আলোচনা না করাই ভাল। ফলে অতিরিক্ত বা একটু বেশি বৃষ্টিপাতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় (যেখানে কোনো সময় জল জমত না) নোংরা জল কিছু সময়ের জন্য নাগরিক জীবন বিপন্ন করে।

সর্বোপরি নর্দমার উপর ঢালাই কংক্রিটের রাস্তার নিচে নর্দমা যখন ছ'মাস ন'মাসে নোংরা জল অপসারণের জন্য বাধ্য হয়ে পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হয়। শহরে সবুজায়নের অবস্থা তথৈবচ। মোগল আমলের স্মারক খাজা আনোয়ার বেড় অঞ্চল। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্র এই অঞ্চলে পর্যটন উন্নয়নকে ঘিরে অনায়াসে কর্মসংস্থানের ভ্রমণ সূচক পরিকল্পনা নেওয়ার সুযোগ ছিল, এখনও আছে। শহরের এই এলাকায় জলস্তর কিন্তু বিপজ্জনকভাবে কমে গেছে বিগত দুই দশকে। এখনও যে কটি পুকুর, জলাশয় আছে; দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় সেখানে এক ফোঁটা জল নেই, এমনকি নোংরা জলও জমে না।

ঐতিহাসিক রাজপথ জি টি রোড শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কিন্তু সেই রাজপথের আর সে কৌলিন্য নেই। রাস্তার ধারে আর দেখতে পাওয়া যায় না একটিও প্রাচীন ঐতিহ্যশালী বৃক্ষ। উন্নয়নের ধারায় তারা সকলেই কালের খাতায় হারিয়ে গিয়েছে। সেজন্য আসন্ন পৌরসভার নির্বাচনে শহরের গলি রাস্তায় আলোক স্তম্ভ এবং পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নটি নিশ্চিতভাবেই বর্ধমানবাসীকে ভাবাবে!

আরও পড়ুন
Advertisement