শেক্সপিয়র সরণির সেই বাড়ি। নিজস্ব চিত্র
খণ্ডিত বাঙালির খণ্ডিত ইতিহাস নিয়ে টানাপড়েন। তাও উঠে আসছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে। কলকাতায় এ বার পড়শি দেশের প্রধানমন্ত্রী আসছেন না ঠিকই। তবে কলকাতার একটি বিশেষ ঠিকানার কথা দু’দেশের কূটনীতিকদের পর্যায়ে উঠে আসার সম্ভাবনা।
আজকের ৮ নম্বর শেক্সপিয়র সরণি। তাতে মিলে গিয়েছে উপমহাদেশের ইতিহাসের দু’টি পর্ব। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর সামনে পাক সেনাপতি নিয়াজির আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে তৎকালীন থিয়েটার রোড়ের এই বাড়ি থেকেই ঢাকা উড়ে যান সদ্যোজাত বাংলাদেশের প্রতিনিধি, মুজিবনগর সরকারের বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার। বাংলাদেশের প্রথম সরকার, মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী সদর তখন থিয়েটার রোড়ের সেই বাড়ি। বিজয় দিবসের কয়েক দিন আগে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে লেখা চিঠি ওই বাড়িতে পাঠিয়েই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সবার আগে স্বীকৃতিও দেন এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
তাজউদ্দিন থিয়েটার রোডের বাড়িতেই থাকতেন, অফিস করতেন, মেসে সবার সঙ্গে খেতেন। মুজিবনগর সরকারের সচিবালয়, সেনাপ্রধান, বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন, পুলিশের আইজির অফিস সব ওই ঠিকানায়। বাড়িটি যেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের ব্যাকস্টেজ। মুজিবনগর প্রশাসনের মাথারা ওই বাড়ি থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের ১১টি সেক্টরের সঙ্গে সারা ক্ষণ যোগাযোগ রাখতেন।
আবার ওই বাড়িতেই মিশে আছে ভারতের এক মহান মনীষীরও স্মৃতি। পুদুচেরীতে পরিণত বয়সের শ্রী অরবিন্দও তাঁর ‘গ্রাম’ বলতে থিয়েটার রোডের কথা বলতেন। ১৮৭২ সালের ১৫ অগস্ট থিয়েটার রোডের বাড়িতেই অরবিন্দ ঘোষের জন্ম। তখন ঠিকানা ছিল ৪ নম্বর থিয়েটার রোড। অরবিন্দের পিতৃবন্ধু মনমোহন ঘোষের বাড়ি। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় শ্রী অরবিন্দ মেমোরিয়াল আইন পাশ করে ১৯৭২এ অরবিন্দের শতবর্ষেই শ্রী অরবিন্দ ভবন এবং শ্রী অরবিন্দ সমিতি গঠন করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। থিয়েটার রোডের বাড়িতেই অরবিন্দ ভবনের যাত্রা শুরু হয়। সেখানে অরবিন্দের অস্থি এনে সংরক্ষণও করা হয়েছে। উঠোনে গড়ে উঠেছে উপাসনাস্থল। তার কয়েক মাস আগে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। যখন অরবিন্দের বাড়ির পাট গুটিয়ে সরে যায় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার।
কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের মাধ্যমে সেই বাড়ি অধিগ্রহণের জন্য দিল্লির বিদেশ দফতরে আর্জি গিয়েছে। ঢাকার দাবি, দিল্লি বলেছে এতে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দিল্লি সফরে ফের ঢাকার তরফে অরবিন্দের বাড়ি অধিগ্রহণের কথাটি উঠতে পারে। অরবিন্দ ভবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাস্টের চেয়ারপার্সন পদাধিকারবলে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল। জগদীপ ধনখড়ের পরে নবনিযুক্ত রাজ্যপাল লা গণেশনের সঙ্গে ইতিমধ্যে দেখা করেছেন কলকাতায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা। অরবিন্দ ভবন পরিচালনার অন্যতম শরিক কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গেও তাঁরা কথা বলেন। তবে এখনও পর্যন্ত কেউই আশ্বাস দিতে পারেননি। অরবিন্দ ভবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে চাননি।
বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের বক্তব্য, “শ্রী অরবিন্দ আমাদের দেশেও গভীর শ্রদ্ধা, ভালবাসার। আবার তাঁর জন্মস্থানের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মলগ্নও অবিচ্ছেদ্য। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিমাখা অন্তত ২৮টি বাড়ি কলকাতায়। কিন্তু অরবিন্দ ভবনের মতো স্থানমাহাত্ম্য বিরল।” এখন বাড়িটিতে ঢুকলেই চোখে পড়ে অরবিন্দের বিভিন্ন ছবির সঙ্গে ফ্রেমবন্দি তাঁকে নিয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের উদ্ধৃতি। আলিপুর বোমা মামলার শুনানির সময়ে দেশবন্ধুর ভাষায় দেশাত্মবোধের কবি, জাতীয়তাবোধের দ্রষ্টা, মানবতাবোধের প্রেমিক অরবিন্দের কথা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কোনও চিহ্ন নেই। ঢাকার তরফে তাই বলা হয়েছে, দরকারে দু’টি দেশ মিলে একযোগে বাড়িটিতে ইতিহাসের দু’টি পর্বের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখুক। একজন মহান দেশপ্রেমী, চিন্তানায়ক এবং একটি মহান দেশের প্রথম সরকারের সূতিকাগার, দু’টিই যাতে আগামী প্রজন্ম চিনতে পারে।