The Kerala Story

মমতার কেরালা নির্দেশকে ‘বেঠিক’ বলছেন শুভাপ্রসন্ন, তবে অভিনেতা কৌশিক, কবি সুবোধ সরকারের পাশে

‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটি রাজ্যে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিজেপি। বিশিষ্টরাও সকলে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত নন। তবে সকলেই নবান্নের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন এমনও নয়।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৩ ১৪:০০
image of Mamata Banerjee, Kaushik Sen, Subodha Sarkar, Suvaprasanna.

রাজ্য সরকারের তরফে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।

বিতর্কিত ছবি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ বাংলায় বিতর্ক তৈরি করার আগেই তা ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, শান্তি-সৌহার্দ্য বজায় রাখতে এই রাজ্যে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিষিদ্ধ করা হল। এই সিনেমায় যে সব দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তা রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। তাই ছবিটি নিষিদ্ধ করা হল। কলকাতা থেকে জেলা— সর্বত্র শান্তি বজায় রাখতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ বিশিষ্টজনেদের একাংশ এমনটা করা ঠিক হয়নি বলে সরব হয়েছেন। যদিও দলগত ভাবে তৃণমূল ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করছে না। অনেক নেতাকে রাজ্য সরকারের ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁরা ‘বিষয়টি প্রশাসনিক’ বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে মমতা তথা তৃণমূলের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত শিল্পী শুভাপ্রসন্ন সরাসরি বিরোধিতারই পথ নিয়েছেন। কেন এই সিদ্ধান্ত তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু না বললেনও শুভাপ্রসন্নের মন্তব্য, ‘‘এই সিদ্ধান্ত কোনও রাজনৈতিক সুবিধা দেবে না। বরং নিষিদ্ধ করে ছবিটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হল।’’ একই রকম কথা বলছেন নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায় থেকে সুমন মুখোপাধ্যায়েরা। বিভিন্ন সময়ে তৃণমূলের পাশে দাঁড়ালেও এ ক্ষেত্রে একেবারে উল্টো মেরুতে অবস্থান করছেন তাঁরা। তবে মমতার সিদ্ধান্তের পাশে রয়েছেন কবি সুবোধ সরকার এবং অভিনেতা কৌশিক সেন।

Advertisement

রাজ্য সরকারের তরফে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটি নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওই সিদ্ধান্তকে ‘জেহাদিদের কাছে আত্মসমর্পণ’ বলে মন্তব্য করেছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ অন্য নেতারা ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন। আগেই এই ছবিটির প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সোমবার রাত থেকেই কলকাতায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কলকাতা সফরে শাহ রাজ্য সরকারের ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারেন কি না, তা নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। বস্তুত, বিজেপি মমতার ওই সিদ্ধান্তের পিছনে সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ‘প্রভাব’ও দেখছে। ওই ভোটে শাসক তৃণমূলের হারের পিছনে নানা কারণের সঙ্গে অনেকে এমন দাবিও করেছেন যে, সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলকে আর সমর্থন দিচ্ছে না, এমন একটি ‘প্রবণতা’ তৈরি হয়ে থাকতে পারে। বিজেপি মনে করছে, সংখ্যালঘু সমাজকে খুশি করতেই ছবিটি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।

তৃণমূলের ঘরের বিশিষ্টেরাও ওই সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি সমর্থন করতে পারছেন না। কিছুদিন আগেই বাংলা ভাষায় ‘পানি’, ‘দাওয়াত’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে মমতার সঙ্গে সংঘাতের পথে হেঁটেছিলেন শুভাপ্রসন্ন। মঙ্গলবার আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘আমি কোনও শিল্পপ্রচেষ্টার বিরোধিতা পছন্দ করি না। এ ক্ষেত্রেও আমি সমর্থন করতে পারছি না। এর ফলে ছবিটা বেশি প্রচার পেয়ে গেল! ভাল বা মন্দ বিচার করার দায়িত্ব মানুষের উপরেই ছাড়া উচিত। সেন্সর বোর্ড যখন ছাড় দিয়েছে, তখন প্রদর্শনে বাধা কোথায়? এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে কি না জানি না। তবে থাকলেও কোনও সুবিধা মিলবে না বলেই আমার ধারণা।’’

একই কথা বললেন নাট্যকার ও পরিচালক দেবেশ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কোনও ছবি বা নাটকে যদি মনে হয় ভুল কথা বলা হয়েছে, তবে তার পাল্টা নতুন কিছু করতে হয়। সেটার উপরে নিষেধাজ্ঞার কোনও অর্থ হয় না। আমি যেটুকু শুনেছি, তাতে ছবিটা তেমন কিছু হয়নি। মানুষ এমনিতেই গ্রহণ করতেন না। তবে এখন নিষেধাজ্ঞা কৌতূহল বাড়িয়ে দেবে। অনেকেই দেখবেন।’’ এর পিছনে কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে? দেবেশ বলেন, ‘‘আমার রাজনৈতিক ধ্যানধারণা কম। তবে এটা বলতে পারি যে, এই সিদ্ধান্ত ‘দ্য কেরালা স্টোরি’কে বাড়তি সুবিধা দিয়ে দিতে পারে।’’

নাট্যব্যক্তিত্ব সুমনের বক্তব্য, ‘‘এই ছবিটা ঠিক কেমন আমি জানি না। তবে আমি যে কোনও নিষেধাজ্ঞারই বিরুদ্ধে। ‘হারবার্ট’ একটা সময় নন্দন দেখাবে না বলেছিল। ‘হ্যাংম্যান স্টোরি’ বলে একটা ছবি হয়েছিল, যেটা নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য খুব রেগে গিয়েছিলেন। ‘ফায়ার’ ছবির প্রদর্শন নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু এ ভাবে কোনও ছবি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার কথা আমার মনে নেই।’’

সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছেন কবি সুবোধ। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘সিনেমা না দেখে মন্তব্য করা যায় না। তবে সংবাদমাধ্যমে যে সব খবর উঠে এসেছে, তা পড়ে বুঝতে পারলাম, এ তো আগুন! যাঁরা আগুন লাগাতে চাইছেন, তাঁদের স্পর্ধিত স্ফুলিঙ্গে জল ঢেলে না দিলে বিপদ অনিবার্য। সেই জল ঢালার কাজটি করেছেন রাজ্য সরকার।’’ এখানেই না থেমে সুবোধ বলেন, ‘‘কাল যদি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে, তখন তো আপনারাই এক চোখে হাসবেন আর এক চোখে ঝলসে উঠবেন কেন সরকার পড়ে যাচ্ছে না বলে। বরঞ্চ আপনারা বিবিসির তৈরি গুজরাট ডকুমেন্টারিটি কী করে দেখানো যায়, সেটা পুনর্বিবেচনা করুন।’’

রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে বাংলার বর্তমান অবস্থা স্মরণ করিয়েছেন অভিনেতা কৌশিক। তিনি বলেন, ‘‘এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে আমার কাছে ব্যাপারটা দুঃখজনক মনে হয়নি। আমরা যখন ইতিহাসের কথা বলি, তখন মনে রাখতে হবে আমাদের চারপাশটা কত বদলে গিয়েছে। আগে যেটা বুঝতে পারিনি বা বিশ্বাস করিনি কিন্তু এখন বুঝি যে, আমাদের অনেকের মনের গভীরে সাম্প্রদায়িকতা বাস করে।’’ শিল্পের স্বাধীনতার কথা বলতে গেলে সমাজের কথাও মাথায় রাখতে হয় বলেই দাবি তাঁর। কৌশিকের কথায়, ‘‘আমরা শিল্পের স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে চারপাশের বদলে যাওয়াটা মনে রাখি না। আমরা অতীতে কবে দেখেছিলাম যে, মা দুর্গার অসুরকে গান্ধীজির মতো দেখতে? গরিব মানুষ এই ছবিগুলো দেখতে যাবেন না। কিন্তু গোষ্ঠীসংঘাত হলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। যাঁরা এই ছবি দেখবেন, সেই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজটাই সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক। সব ধর্মেই। তাঁরা সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে বিদ্বেষ ছড়াবেন। কিন্তু গোলমাল হলে তাঁদের গায়ে আঁচ লাগে না। ভোগেন গরিবরা।’’

এর পরেই রাজ্যের সিদ্ধান্তকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে কৌশিক বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক কালে যা যা ঘটেছে, তাতে ঝড়ের পূর্বাভাস রয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আবার একটা হিংসার পরিবেশ তৈরি হতে পারে। প্রশাসন সেই ঝুঁকিটা নেবে কেন?’’

আরও পড়ুন
Advertisement